Sylhet Today 24 PRINT

সিলেটের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা

আল আজাদ  |  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৭

একাত্তরের মধ্য ডিসেম্বর। বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা সূর্য উঁকি দিচ্ছে পূর্ব দিগন্তে। জাগতে খুব বেশি দেরি নেই আর। অকুতোভয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন এ মাটির বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা। পাশে মিত্রবাহিনী। পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃপক্ষ বুঝে নিলো, পরাজয় নিশ্চিত। তাই বুনলো চক্রান্তের নতুন জাল। আল বদর, আল শামস ও রাজাকারদেরকে নির্দেশ দিলো, এদেশের বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে দিতে। মীর জাফরের বংশধররা অবলীলায় তাই করলো।

কেবল ডিসেম্বর নয়, এর আগে এমনকি ২৫ মার্চের কালরাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ শুরুর মুহূর্তেও এ মাটির সেরা সন্তান বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি হানাদাররা এদেশীয় ঘাতকদের সহায়তায় এ নিধনযজ্ঞ চালায় অবিরাম পুরো নয় মাস। পরাজয়ের ও আত্মসমর্পণের দুই দিন আগে পর্যন্ত। তবে সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয় ১৪ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার বুকে। নৃশংসতার এমন নজির আর কোথাও নেই।

সিলেট অঞ্চলের অধিবাসী অনেক বুদ্ধিজীবীও দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে আত্মাহুতি দেন।

ডা. শামসুদ্দিন আহমদ
মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ডা. শামসুদ্দিন আহমদ সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ই তিনি রাজনৈতিক নেতাদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আহতদের শুশ্রূষার জন্যে শহরতলিতে খোলা হবে পাঁচটি চিকিৎসা কেন্দ্র। তাঁর এই উদ্যোগ সফল না হলেও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁকে গুলিবিদ্ধ আর বোমার আঘাত প্রাপ্তদের সেবা করতে দেখা গেছে।

পাক সেনারা ৯ এপ্রিল সিলেট শহর পুনঃদখল করে নেয়। সেদিন প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় মুক্তিবাহিনী ও পশ্চিমা দস্যুদের মধ্যে। আহত হয় অসংখ্য সাধারণ মানুষও। সামরিক কর্তৃপক্ষ ডা. শামসুদ্দীন আহমদকে নির্দেশ দেয়, সেনা ছাউনিতে গিয়ে জখমপ্রাপ্ত সেনাদের চিকিৎসা করতে; কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই আহত লোকজনের সেবা করতে থাকেন। এতে তাঁর উপর ক্ষেপে যায় জল্লাদরা। তাই তাঁকে ঐ দিনই সহযোগী ডা. শ্যামল চন্দ্র লালা, সেবক মাহমুদুর রহমান ও অ্যাম্বুলেন্স চালক কোরবান আলী ও আরো কয়েকজনসহ হত্যা করে।

কমর উদ্দিন
বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা গ্রামের কমর উদ্দিন। তিনি ছিলেন বাউল শিল্পী এবং লন্ডন প্রবাসী; কিন্তু দেশের প্রতি টান ছিল বলে শত ব্যস্ততার মাঝেও সবসময় দেশে কখন কি ঘটছে সে খবর রাখতেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার কিছুদিন আগেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। অগ্নিঝরা গান গেয়ে উদ্দীপ্ত করতে থাকেন মানুষকে। তাঁর এই দেশাত্ববোধ এবং কর্মচাঞ্চল্যকে দালালরা মেনে নিতে পারেনি। এ কারণেই ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদারদের দিয়ে তাঁকে হত্যা করায়।

মাওলানা অলিউর রহমান
মাওলানা অলিউর রহমান পেশায় ছিলেন হোমিও চিকিৎসক। তার মূল বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার মইয়ারচর গ্রামের হলেও তিনি থাকতেন ঢাকায়। একাত্তরের ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার সেনারা লালবাগ মসজিদ থেকে স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে ১৪ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে হত্যা করে।

এই প্রখ্যাত আলেম অলিউর রহমান রাজনীতি করতেন। প্রথমদিকে জড়িত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সাথে; কিন্তু এক পর্যায়ে এই ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে গড়ে তুলেন আওয়ামী ওলামা পার্টি। প্রকাশ্যে সমর্থন জানান ঐতিহাসিক ছয় দফার প্রতি। এছাড়া ‘ইসলামের দৃষ্টিতে ছয়দফা’, ‘যুক্তি ও কষ্টি পাথরে ছয়দফা’, ‘জয়বাংলা ও কয়েকটি স্লোগান’ প্রভৃতি বইও লিখেন। স্বতন্ত্র ধর্ম মন্ত্রণালয়ের জন্যে মাওলানা অলিউর রহমানই প্রথম দাবি তুলেছিলেন।

অ্যাডভোকেট রামরঞ্জন ভট্টাচার্য
রামরঞ্জন ভট্টাচার্য ছিলেন একজন আইনজীবী এবং সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি)। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে তিনি স্ত্রী সহ সিলেট শহরের চালিবন্দরের বাসা ছেড়ে চলে যান বালাগঞ্জ উপজেলার বুরুঙ্গা এলাকায় তাঁর এক পরিচিতজনের বাড়িতে। তবে সেখানেও তাঁকে নিরাপত্তার প্রয়োজনে একাধিকবার অবস্থান পরিবর্তন করতে হয়।

একাত্তরের ২৬ মে পশ্চিমা জল্লাদরা বুরুঙ্গায় গণহত্যা চালায়। হত্যা করে ৭৮ জন স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে। এর মধ্যে অ্যাডভোকেট রামরঞ্জন ভট্টাচার্যও একজন। অন্য সবাইকে এক সাথে মারা হলেও এই নিঃসন্তান দেশপ্রেমিক আইনজীবীকে আলাদাভাবে চেয়ারে বসিয়ে প্রাণ সংহার করা হয়।

আব্দুল মান্নান
বিয়ানীবাজার উপজেলার কসবা গ্রামের আব্দুল মান্নান ছিলেন একজন ক্রীড়া সংগঠক ও ফুটবল রেফারি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সাথে সাথেই তিনি হয়ে উঠেন অন্য মানুষ। ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রিয় জন্মভূমির মুক্তির লড়াইয়ে। এ ‘অপরাধে’ পশ্চিমা জল্লাদরা তাঁকে ধরতে হানা দেয় বাড়িতে; কিন্তু না পেয়ে তার স্ত্রী-সন্তানদেরকে ধরে নিয়ে যায়।

আব্দুল মান্নান স্ত্রী-সন্তানদেরকে মুক্ত করতে শেষ পর্যন্ত ধরা দিতে বাধ্য হন। হানাদাররা ৮ জুন হত্যা করে তাঁকে। এর আগে তিনি তাঁর এক ভাইকে পাকিস্তানি পশুদের উপর প্রতিশোধ নেয়ার নির্দেশ দিয়ে একটি চিঠি লিখে যান।

অন্যান্য
এছাড়া অ্যাডভোকেট এম এ হাফিজ, ডা. আব্দুন নূর, ঢাকায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন দার্শনিক ড. জি সি দেব, ড. এম এ মুক্তাদির, অধ্যাপক অনুপ দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য ও প্রকৌশলী মোজাম্মেল আলী এবং চট্টগ্রামে বাঙালি সেনা কমকর্তা কর্নেল এম আর চৌধুরী ও উচ্চপদস্থ রেল কর্মকর্তা শফি আহমদকে পশ্চিমা হায়নার দল এবং ঘাতক রাজাকার-আল বদর-আল শামসরা হত্যা করে।

 

লেখক: সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.