Sylhet Today 24 PRINT

‘এখন ইতিহাসের বিকৃত চর্চা হচ্ছে’

মারূফ অমিত |  ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭

"আজকে আমাদের ইতিহাস বিকৃত। যে যার ভাবে ইতিহাস তৈরি করে নিচ্ছে।  আমাদের নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানতেই দেওয়া হচ্ছে না। আমরা কোন দলের রাজনীতি করি না। কিন্তু খুব দুঃখ লাগে আজ ৪৬ বছর পরও বিভিন্ন অদ্ভুত কথাবার্তা শুনতে"। এভাবেই আক্ষেপ করছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান।

১৫ ডিসেম্বর (শুক্রবার) সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিল ৯ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানের সাথে।

মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান জানান, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে তাদের ১৩ জনের একটি দল বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। প্রবেশ করতেই পড়েন পাকিস্তানি মেলেটারির বাঁধার মুখে। সম্মুখ যুদ্ধ হয় পাক মেলেটারির সাথে।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের প্রথমদিকে যশোর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে যশোরের বড়দিয়া এলাকায় একটি ছোট নদী পার হওয়ার সময় পাক মেলেটারীরা আমাদের ঘিরে ফেলে। কোন মতে আমরা নদীটা পার হই পাক মেলেটারির গুলি বর্ষণের মধ্যে। পাড়ে পৌছে সেখানে থেকেই আমরা গুলি চালাই পাক মেলেটারির উপরে। আমি তখন স্টেনগান দিয়ে ফায়ার করছিলাম পাগলের মত। তিনটা পাক মেলেটারিকে একবারে বুঝে বুঝে এটেম করি। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে আমাকে কভার করা একজনের উপর পাকিস্তানি মেলেটারিরা এল এম জি নিক্ষেপ করলে সে ঝাঝরা হয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রবল গুলি বর্ষণের মধ্যে পাকিস্তানীরা টিকতে না পেরে কোন মতে তাদের লঞ্চ নিয়ে পিছু হটে পালিয়ে যায়। এর পর থেকে ঐ নদী দিয়ে কখনই আর পাকিস্তানী মেলেটারিরা আসে নি।

মুক্তিযুদ্ধের এমন সম্মুখ যুদ্ধের ঘটনা বলতে বলতে মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান জানান, ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ভারত চলে যান ট্রেনিং নিতে। তার মেজো চাচা এম এ কাদেরের সহায়তার তিনি ভারতে যেতে পারেন। তিনি জানান, ভারতের বশীরহাট এলাকার বেগুনদিয়া ক্যাম্পে তিনি ট্রেনিং নেন।

হাবিবুর রহমান সে সময়কার কষ্টের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমার মা জানতেন না যে আমি মুক্তিযুদ্ধে চলে যাচ্ছি। শুধু আমার বাবা আর আমার মেজো চাচা জানতেন। তখন বাড়ি থেকে যাবার সময় কোন টাকা পয়সা ছিল না। মায়ের এক জোড়া স্বর্ণের কানের দোল ছিল। সেখান থেকে একটা কানের দুল নিয়ে যাই। পরবর্তীতে ভারতে গিয়ে সেটা ৪৭০ বা ৪৮০ টাকায় বিক্রি করেছিলাম। সে টাকা দিয়ে নিজে খরচ করেছি, ক্যাম্পের অন্যান্যদের ও কিছু দিয়েছি।

তিনি জানান, আমার মেজো চাচা এলাকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সব সময় আশ্রয় দিতেন। আমি মুক্তিযুদ্ধে যাবার পর এক দালাল ছিল হালিম খাঁ নাম। পাকিস্তানীদের এই দালাল খুব জ্বালাতন করত বাড়িতে এসে। কত মানুষকে যে টর্চার করছে এই রাজাকার তা বলে শেষ করতে পারব না। জামায়াত ইসলামের এই লোক এলাকার পিচ কমিটির (শান্তি কমিটি) চেয়ারম্যান ছিল। যুদ্ধের পর পর মুক্তিবাহিনীর লোকজন তাকে মেরে ফেলে।

বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান জানান, এখন দেশ অনেক ভালো, আগাচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ খারাপ দিক হলো এখনো আমাদের ইতিহাসের বিকৃত চর্চা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ৭৫ থেকেই এই চর্চা শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, এই মনে করেন জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেছে কালুরঘাট থেকে। জিয়া বেঁচে থাকতে কখনো নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবী করেন নাই। কিন্তু এখন তার দল এটা ঢালাও ভাবে প্রচার করছে। এটা স্রেফ মিথ্যাচার। আমরা কোন রাজনীতি করি না কিন্তু এসব ত মেনে নেওয়া যায় না।

তিনি আরও বলেন, এই দেখেন 'জয় বাংলা' শ্লোগান জাতীয় শ্লোগান কেন নয় তা নিয়ে আদালতে শুনানি হচ্ছে। কিন্তু এটাতো কোন রাজনৈতিক দলের শ্লোগান নয়। এটা আমাদের সবার শ্লোগান। কোন দল সেই শ্লোগান দিলে ভালো, কিন্তু সেটাকে দলীয় শ্লোগান বললে ত ইতিহাসকেই বিকৃত করা হয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান সবার শ্লোগান, জাতীয় শ্লোগান। এত বছর পর এই শ্লোগান কেন জাতীয় শ্লোগান নয় এসব নিয়ে আলোচনা করাটা আমাদের জন্য লজ্জাকর।

হাবিবুর রহমান জানান, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা চাই আমাদের ছেলে মেয়ে, তাদের ছেলেমেয়ে সঠিক ইতিহাস জানুক, সৎ পথে চলুক। বাংলাদেশকে ভালবাসুক।

মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৯ নভেম্বর বাগেরহাটের চিতলমারি এলাকায়। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সনদ নং  'ম  ১৬৮৯৮৫' এবং সেনাবাহিনী গেজেট মুক্তিযোদ্ধার তথ্য মতে তাঁর গেজেট নাম্বার "১০৫৫৮"।  ১৯৭৪ সালের ৮ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং অবসর নেন ১৯৯০ সালের ৭ জানুয়ারী। পরবর্তীতে ৯১ সালের  ২ মার্চ সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় নিরাপত্তা শাখায় কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। সহধর্মিনী, দুই ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কচুয়াবহর এলাকায় বসবাস করছেন।  

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.