Sylhet Today 24 PRINT

শহীদ বুদ্ধিজীবী রায়সাহেব কামিনী কুমার ঘোষ

মাসুদ পারভেজ |  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

বাংলা মায়ের জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু আলোকিত মানুষ। যারা নিজ স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অন্যের জন্য কাজ করে গেছেন আজীবন। আলো জ্বেলে আলোকিত করার এই বাসনায় বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশেরও আগে এই তল্লাটে গুণীজনরা আমাদের এই সময়কার ইতিহাসকে ঋদ্ধ করেছেন অকাতরে। বর্তমান সময়ে এসে যার সুফল আমরা ভোগ করছি কিংবা উপভোগ করছি অনিন্দ্যসুন্দর পসরা যার আদি আগেই।

সবুজ বাংলার শ্যামল প্রান্তর কাঞ্চনা। বলতে হয়, ঐতিহ্যবাহী কাঞ্চনা। সাতকানিয়া থানার আওতাধীন এই কাঞ্চনাতে জন্ম বহু আলোকিত মানুষের। যাদের পদাচারণায় মুখরিত জনপদের সংখ্যা সংখ্যাতীত। তেমনি এক আলোকিত মানুষ শহীদ বুদ্ধিজীবী রায়সাহেব কামিনী কুমার ঘোষ। যিনি ইতিহাসের বহু সন্ধিক্ষণের সাক্ষী।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য তিনি বিনিয়োগ করেছেন দেশের জন্য। প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ প্রতিষ্ঠা কিংবা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাথে কামিনী কুমার ঘোষের নাম ওতপ্রোতভাবে লেগে আছে। প্রান্তিক জনপদে উনার ছোঁয়ায় বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে আমূল পরিবর্তিত হচ্ছিল কাঞ্চনা। যার পুরোধা এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ। গ্রামের মানুষকে আলোকিত করার মহান ব্রত নিয়ে জনপদ আলোকিত করা এই ক্ষণজন্মার উদ্দেশ্য ছিল বিশালাকার। তাই, আমরা দেখতে পায় একের পর একে শিক্ষালয় স্থাপনের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করে একটা জনপদের অগণিত মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মহান দায়িত্বে তিনি ছিলেন সদা বিরামহীন।

অথচ এই দেশবরেণ্য মহান শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারককে ঘাতকের দল বাঁচতে দেয় নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে নিজেকে উজাড় করে দেওয়া রায়সাহেব কামিনী কুমার ঘোষকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এদেশের রাজাকাররা মিলে ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল নিজ বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করে। সেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় কুলাঙাররা রায়সাহেব কামিনী কুমার ঘোষের নিজ গ্রামের অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পুড়িয়ে মারে বহু বাঙালিকে।

দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী রায়সাহেব কামিনী কুমার ঘোষ হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন করতে পারলাম না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলা কোন এক অজানা কারণে স্তিমিত হয়ে আছে। যদিওবা ঘাতক এখনও বহাল তবিয়তে দিনযাপন করছে। এ দুঃখ আমাদের; এ লজ্জা আমাদের।

এতদঞ্চলে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর সুহৃদ শহীদ বুদ্ধিজীবী রায়সাহেব কামিনী কুমার ঘোষের বর্ণাঢ্য জীবনীর চুম্বকাংশ নিম্নে আলোকপাত করা হল:

• জন্ম ১৮৮৮ সালে। পিতা- চৈতন্য চরণ ঘোষ, মাতা- কমলা ঘোষ।
• ১৯০৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রাস পাস এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আই.এ পাস।
• ১৯০৮ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা গমন। স্বনামধন্য প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে বিএ (অনার্স) করেছেন ১৯১০ সালে।
• ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে এম.এ পাস। একই সাথে আইনশাস্ত্রে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
• দেশে ফিরে আসেন ১৯১৩ সালে। চট্টগ্রাম জর্জ কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। এবং একই বছরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
• ১৯২১ সালে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে জড়িত হন। এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলের পুরোধা হিসেবে লোকজনকে সংগঠিত করতে থাকেন।
• ১৯২২ সালে তিনি (কাঞ্চনা, ডলুকূল, আমিলাইষ) ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হন। তিনি সে সময়ে সাতকানিয়া-বাঁশখালি এডুকেশন সোসাইটি গঠন করে গ্রামে-গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে সফল হন।
• ১৯২৯ সালে তিনি বাল্যবন্ধু ললিত মোহন চৌধুরী ও স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের নিয়ে “আমিলাইষ কাঞ্চনা বঙ্গ চন্দ্র ঘোষ ইন্সটিটিউট” প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দান করেছিলেন কাকা বঙ্গ চন্দ্র।
• ১৯৪৮ সালে সাতকানিয়া কলেজ (সাতকানিয়া সরকারি কলেজ) প্রতিষ্ঠার অন্যতম ছিলেন তিনি, এবং প্রথম অবৈতনিক অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
• ১৯৬৯ সালে কাঞ্চনায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য আমিলাইষ কাঞ্চনা বঙ্গ চন্দ্র ঘোষ ইন্সটিটিউটকে সম্প্রসারিত করে নতুন ভুবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন।

এই দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, মানবতার মহান বন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক রায়সাহেব কামিনী কুমার ঘোষের বর্ণাঢ্য জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকাররা। ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল নিজ বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাকে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী রায়সাহেব কামিনী কুমার ঘোষের সমাজ চিন্তার মহান ধারা আজও সগৌরবে উজ্জ্বল আমাদের জীবনীতে। এই মহান ক্ষণজন্মা শুধু কাঞ্চনাকেই আলোকিত করেননি বরং পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছাপিয়ে উনার কীর্তি আজ সারাদেশে ভাস্বর।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জাতির এই মহান দূতকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করি। এবং জাতি গঠনে উনার অবিস্মরণীয় অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।

  • মাসুদ পারভেজ: কবি, প্রাবন্ধিক; প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, শহীদ বুদ্ধিজীবী রায়সাহেব স্মৃতি সংসদ।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.