Sylhet Today 24 PRINT

১৪ বছর বয়স বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যান হবিগঞ্জের আব্দুস শহীদ

শাকিলা ববি |  ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯

১৯৭১ সাল, পাক হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবে সারা দেশ উত্তাল। পাকিস্তানিদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে যুদ্ধে যাচ্ছে যুবক-তরুণরা। দেশের এমন দুর্দিনে ঘরে বসে থাকতে পারেননি হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার কিশোর মো. আব্দুস শহীদও।

তখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর। সারাদিন ঘুরাফেরা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়াতেন। এর মধ্যেই দেশে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনেন কিশোর শহীদ। সেই ভাষণে অনুপ্রানিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পরিবারের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে।
 
বলছিলাম সিলেট বিভাগের কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার মিরপুর ইউনিয়নের কুটান্দর গ্রামের প্রয়াত মো. আব্দুস শহীদের কথা। যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের ত্রিপুরায় ১মাস ট্রেনিং নিয়ে খোয়াই ৩নং সেক্টর থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। মো. আব্দুস শহীদ চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ বিদায় জানান হবিগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ।
 
মো. আব্দুস শহীদের যুদ্ধকালীন স্মৃতি নিয়ে কথা হয় তার ছোট ছেলে আব্দুল্লাহ আল হাসান হৃদয়ের সাথে। বাবার সর্ম্পকে বলতে গিয়ে বার বার আবেগতাড়িত হচ্ছিলেন হৃদয়। বাবার বীরত্বের কথা বলতে ছিলো গর্বও।
 
হৃদয় বলেন, জীবিত অবস্থায় বাবার ধ্যানে জ্ঞানে ছিল মুক্তিযুদ্ধ। যখনই সুযোগ পেতেন আমাদেরকে যুদ্ধের কাহিনী শোনাতেন। অবসর সময়, খাবার টেবিলে, কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সময় যখনই মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কিছু দেখতেন তখনই যুদ্ধের গল্প শোনাতেন। আমরা ভাই বোনেরাও বড় হয়েছি বাবার যুদ্ধের গল্প শুনে।
 
হৃদয় বলেন, যুদ্ধকালীন সময় বাবা ছিলেন কিশোর তাই তাকে দিয়ে মূলত রেকি করানো হত। সম্মুক্ষ সমরের আগে রেকি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাবা ছোট ছিলেন তাই তাকে দিয়ে রেকি করাতে সুবিধা হতো।
 
হৃদয় বলেন, একবার রোজার ঈদের সময় বাবা আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি গল্প শোনালেন। গল্পটা ছিল, ১৯৭১ সালে তখন রোজার ঈদের তিন দিন বাকি। তখন রেকি করতে গিয়ে শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার ওসি বাবা ও তার সঙ্গে থাকা আরও চারজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানিদের কাছে ধরিয়ে দেয়। ওই সময় তার সঙ্গে থাকা চার জনকে মেরে ফেলে পাকিস্তানিরা। বাবার বয়স কম থাকায় তাকে প্রাণে মারেনি। কিন্তু প্রাণে না মারলেও বেধরক মারধর করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। যার ফলে ডান কানে কিছুই শুনতে পেতেন না বাবা। ওইসময় তার সব দাঁত নড়ে যায়। তাই অসময়ে তার সব দাঁত পড়ে যায়।   
 
 মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার একটি অপারেশনের কথাও জানান হৃদয়। হৃদয় বলেন, ২২ পাঞ্জাব ১নং হেড কোয়াটার ছিল মৌলভীবাজারে। আর সেখানে কোম্পানি ফোর্স ছিল ওয়াপদা পাওয়ার স্টেশন শ্রীমঙ্গলে। ওই কোম্পানির দায়িত্ব ছিল মেজর ইউসুফ খানের উপর। ওই কোম্পানির উপর আক্রমন করার নির্দেশনা আসে বাবা যে সেকশনে যুদ্ধে করতেন তাদের উপর। তখন তারা শ্রীমঙ্গল গিয়ে ওই জায়গার ভালোভাবে রেকি করলেন। কিন্তু ওই ডাক বাংলোর ভিতরে প্রবেশ করার মত কোনো সুযোগ পাচ্ছিলেন না তারা। তখন বাবা ছদ্ধবেশে ছেড়া গেঞ্জি পেন্ট পরে জুতা পালিশের বক্স নিয়ে ডাক বাংলোর প্রধান ফটকের সামনে বসে থাকতেন। এর সুবাদে প্রায়ই পাকিস্তানি আর্মিরা জুতা পালিশের জন্য বাবার শরীর তল্লাশী করে তাকে বাংলোর ভিতরে নিয়ে যেত। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর তারা বাবাকে আর তল্লাশি করতো না। তখন বাংলোর ভিতরের পাকিস্তানিদের অবস্থানগত সকল তথ্য তিনি মুক্তিবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করতেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে শ্রীমঙ্গলের কালেঙ্গায় এন্টিট্রেক মাইনের মাধ্যমে পাকিস্তানি মেজর ইউসুফ খানকে হত্যা করে তৎকালীন ১০০ টাকা পুরুস্কার পেয়েছিলেন বাবা।   
   
বাবার যুদ্ধকালীন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কে এম শফিউল্লাহ ও স্থানীয় কমান্ডার ছিলেন আইয়ুব আলী। ডিসেম্বরে যুদ্ধশেষ হলে তিনি সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে হবিগঞ্জ পি টি আই স্কুলে অবস্থান করেন এবং হবিগঞ্জ পোদ্দার বাড়ি সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদ চৌধুরীর কাছে অস্ত্র জমা দেন।
 
হৃদয় বলেন, যুদ্ধকালীন সময়ে বাবা থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এস এল আর রাইফেল (রাশিয়ান), স্টেনগান চালিয়েছেন। তিনি মাইন পুতে রাখতে পারদর্শী ছিলেন। বাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এরকম অসংখ্য যুদ্ধের গল্প শুনেছি আমরা ভাই বোনেরা। আমরা ভাই বোনেরা গর্ব করে বলি আমাদের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.