Sylhet Today 24 PRINT

কোভিড-১৯ কেড়ে নিল কামরানকেও

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ১৫ জুন, ২০২০

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনাভাইরাসে হু হু করে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এই ঘাতক ভাইরাসের হাত থেকে রেহাই যাচ্ছেন না সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকরা। এছাড়া রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার, শিক্ষক, ব্যবসায়ীরাও যুক্ত হচ্ছেন আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকায়। এবার সেই করোনাভাইরাস কেড়ে নিল সিলেটের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে।

রোববার দিবাগত রাত ৩টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বদরউদ্দিন আহমদ কামরান মারা যান।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তিন বড় নেতার পতন হলো গত তিনদিনে। তারা হলেন-আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। এই তিন নক্ষত্র তাদের স্বীয় কর্মের মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকা এবং জাতীয়ভাবে সারা দেশের কাছেই পরিচিত।

মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে যেমন শোক চলছে তেমনি আবার আতঙ্কও বিরাজ করছে। বিশেষ করে করোনা সংক্রমণ নিয়ে শঙ্কাটাই বেশি। কারণ মারা যাওয়া তিনজনই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। এর মধ্যে মোহাম্মদ নাসিম ৯ জুন আইসিইউতে থাকা অবস্থায় করোনামুক্ত হন। আর ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শেখ মো. আবদুল্লাহ মারা যাওয়ার পর করোনা পজিটিভ বলে শনাক্ত হন।

সোমবার (১৫ জুন) সকাল ৭টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে থেকে অ্যাম্বুলেন্স যোগে কামরানের মরদেহ নিয়ে সিলেটের পথে রওনা হয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের দুটি জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। প্রথমটি তার নিজ এলাকায় ছড়ারপাড় জামে মসজিদে। আর দ্বিতীয়টি মানিকপীর (র.) এর কবরস্থানে, যেখানে তাকে দাফন করা হবে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের টানা দুইবারের মেয়র কামরান গত ৫ জুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। পরদিন তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর তার শরীর আরও খারাপ হলে ৭ জুন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে তাকে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ৮ জুন কামরানের শরীরে প্লাজমা থেরাপিও দেওয়া হয়েছিলে।

তবে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সোমবার ভোরে মারা যান সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক এই সভাপতি।

বিজ্ঞাপন

গত ২৭ মে কামরানের স্ত্রী আসমা কামরানেরও করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। তিনি অনেকটা সুস্থ রয়েছেন এবং বাসায় আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে পরিবার জানিয়েছে।

উল্লেখ্য, সিলেট পৌরসভার সর্বকনিষ্ঠ কমিশনার নির্বাচিত হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন কামরান। এরপর থেকেই রাজনীতিতে তার উত্থান পর্ব শুরু। ১৯৬৯ এর উত্তাল সময়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি কামরানের। ১৯৭২ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকা অবস্থায় সিলেট পৌরসভার সর্বকনিষ্ঠ কমিশনার হয়ে চমক দেখান তিনি। সেই থেকেই সিলেট পৌরসভার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েন। টানা ১৫ বছর ছিলেন পৌরসভার কমিশনার। মাঝখানে প্রবাসে থাকায় একবার নির্বাচন থেকে বিরত ছিলেন। ফিরে এসে ১৯৯৫ সালে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন হলে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পান কামরান।

২০০৩ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন তিনি। ওয়ান ইলেভেনের সময় দুই বার কারাবরণ করতে হয় এই নেতাকে। ২০০৮ সালে কারাগারে থাকা অবস্থায় নির্বাচনে লড়ে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন। তবে সর্বশেষ দুটি সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চোধুরীর কাছে হেরে যান তিনি।

বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গত শনিবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে রাজধানীর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মৃত্যুকালে মোহাম্মদ নাসিমের বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে মোহাম্মদ নাসিমের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর হঠাৎ করে তার ব্রেইন হেমোরেজ (মস্তিকে রক্ষক্ষরণ) হলে তাৎক্ষণিকভাবে তার সার্জারি করা হয়। আটদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চিরদিনের মতো পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক।

রোববার (১৪ জুন) সকাল সাড়ে ১০টায় বনানী কবরস্থান মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয় মোহাম্মদ নাসিমকে। জানাজা শেষে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এখন মায়ের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।

সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে মোট ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে তিনি শপথ নেন। তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

এর আগে ১৯৯৬ সালের সরকারে স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন নাসিম। সর্বশেষ তিনি ১৪ দলীয় মহাজোটের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগের আরেক কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, দলের সাবেক ধর্মবিষয়ক সম্পাদক, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শেখ মো. আবদুল্লাহ গত শনিবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাত ১০টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) আইসিউতে ভর্তি করা হয় আবদুল্লাহকে। মৃত্যুর পর জানা যায়, করোনা পজিটিভ ছিল ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর।

শেখ মো. আবদুল্লাহ ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে ব্যস্ততার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৭ মে তার নির্বাচনী এলাকার (টুঙ্গীপাড়া-কোটালীপাড়া) উন্নয়নে প্রতিনিধির দায়িত্ব দেন তাকে।

ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শেখ মো. আবদুল্লাহ ১৯৪৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার মধুমতী নদীর তীরবর্তী কেকানিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ধার্মিক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

রোববার বাদ আসর জানাজা শেষে প্রতিমন্ত্রীর গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার কেকানিয়ার পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। এর আগে বাড়ির মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রয়াতের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ধারণ করে ছাত্রজীবনেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন শেখ মো. আবদুল্লাহ। তিনি খুলনার আযম খান কমার্স কলেজে প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন।

১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে রাজনীতিতে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হন। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে তিনি আওয়ামী যুবলীগে যোগদান করেন। এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর সরাসরি তত্ত্বাবধানে গঠিত গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্ট মুজিব বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

তিনি ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশসেবা করার লক্ষ্যে চাকরির পরিবর্তে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং তার নেতৃত্বে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরপর কাউন্সিলের মাধ্যমে গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দীর্ঘদিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।

প্রসঙ্গত, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হলো ৮৭ হাজার ৫২০ জন। আর করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ১৭১ জন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন ১৮ হাজার ৭৩০ জন। আর সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ লাখ ছুঁই ছুঁই করছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৯৮০ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ৪১ লাখ ৩০ হাজার ৫৬ জন।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.