Sylhet Today 24 PRINT

পীরগঞ্জের হিন্দুপাড়ার চারদিকে পোড়া গন্ধ আর বিলাপ

সিলেটটুডে ডেস্ক |  ১৮ অক্টোবর, ২০২১

‘আমরা খাবার খেতে বসছি, পরে দেখি কোপাকুপি, তারপর দেখি আগুন। পরে এসে দেখি দোকানে, মন্দিরে, বাড়িতে আগুন দিয়েছে। ঘরের মেয়ে-বউ-নাতি নিয়ে মানুষের বাড়ির পেছনে কলা গাছের নিচে লুকিয়ে ছিলাম। নাতি কান্না করছিল, তার মুখ চেপে রাখি। এরপর ফিরে এসে দেখি লেপ তুলে কিস্তির সব টাকা নিয়ে গেছে।’

রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর কসবা গ্রামে রোববার রাতে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির কথা জানাচ্ছিলেন সুবালা রানী। তিনি থাকেন গ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত উত্তরপাড়ায়। রোববার রাতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এলাকাটি। এই গ্রামের দক্ষিণপাড়াটি অবশ্য রক্ষা পেয়েছে পুলিশি প্রতিরোধের কারণে।

জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) বিপ্লব কুমার সরকার জানান, হামলায় জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে অভিযান শুরু করা হয়েছে। সোমবার সকাল ১০টা পর্যন্ত আটক হয়েছে ৪০ জন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামের উত্তরপাড়ার অন্তত ২৩ বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়েছে। অনেক বাড়ির সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙা আসবাব, লোকজনের চোখে-মুখে আতঙ্ক আর ক্ষোভ। চারদিকে পোড়া গন্ধ আর বিলাপ।

গ্রামজুড়ে টহল দিচ্ছে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি। নিরাপত্তা তদারকিতে আছেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) বিপ্লব কুমার সরকার।

ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সামনে শূন্য দৃষ্টিতে বসে থাকা নন্দ রানী বলেন, ‘গাড়ি পুড়ি ফেলাইছে, গরু নিয়ে গেছে, চাউল-ডাউল, ট্যাকা-পয়সা সব নিয়ে গেছে, সোনা আছলো এক ভরি- তাকো নিয়ে গেছে। হামরা এখন কী করি খামো বাবা, কী করি খামো।’

ক্ষতিগ্রস্ত আরেক বাড়ির কিরোন বালা বলেন, ‘এই দেশে থাকার চেয়ে মরাই ভালো। ভয়ে রাতে পালায় ছিলাম। পরে পুলিশ এসে বলে তোমরা পালাও কেন। এখন এসেছি, দেখি কিছু নাই। সোনা-দানা নিয়ে গেছে।’

বিকাল বাবু নামের একজন জানান, হামলাকারীরা বাড়িঘরে আগুন দিতে শুরু করলে তিনি শিশুসন্তানকে নিয়ে পাশের ক্ষেতে লুকিয়ে ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘যখন আগুন দেয়, তখন আমি বাচ্চা নিয়ে ঘাসের জমিতে লুকিয়ে ছিলাম। বাড়ির সব টাকা-পয়সা নিয়ে গেছে। বাচ্চাকে বিস্কুট কিনে খাওয়ানোর মতো টাকাও নেই।’

এসপি ও গ্রামবাসী জানায়, গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ১৫ বছরের এক কিশোর রোববার বিকেলে ফেসবুকে কোনো একটি পোস্টে আপত্তিকর একটি কমেন্ট করে।

মুহূর্তে এর স্ক্রিনশট আশপাশের গ্রামের মুসল্লিদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে একদল লোক ওই কিশোরের গ্রামে উপস্থিত হয়।

পুলিশ জানায়, তারা খবর পাওয়ামাত্র সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষুব্ধ লোকজনকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠায়। তবে এর দুই ঘণ্টা পর শুরু হয় আকস্মিক হামলা।

গ্রামবাসী জানায়, রাত সাড়ে ৮টার দিকে কয়েক শ’ লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে দক্ষিণপাড়া থেকে কিছুটা দূরে ক্ষেতের ওপারে স্থানীয় মসজিদে জড়ো হয়। পরে রাশেদ নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে তারা গ্রামের উত্তরপাড়ায় প্রবেশ করে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে।

হামলাকারীরা বাড়িঘরে ভাঙচুর ও আগুন দিতে থাকে। দুটি মন্দিরও ভাঙচুর করা হয়। লুট করা হয় স্বর্ণালংকার, টাকাসহ দরিদ্র পরিবারের নানা জিনিসপত্র। রাত ১১টা পর্যন্ত চলে এ অবস্থা। ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট গিয়ে আগুন নেভায়।

ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, গায়ের কাপড় ছাড়া তাদের আর কিছু অক্ষত নেই। ওই পাড়ার অর্ধশত পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের অনেকে আছে খোলা আকাশের নিচে।

নারায়ণ চন্দ্র নামের একজন বলেন, ‘আমি বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। রাতে খেয়ে বসে আছি। শুনছি ওই গ্রামে একজন ফেসবুকে কী লিখছে, পুলিশ আসছে। আমরা শুনছি। এর কিছুক্ষণ পর দলে দলে মানুষ আসতে শুরু করলো। ভাঙচুর আর আগুন দেয়া শুরু করল তারা। ভয়ে ভাগনেকে নিয়ে পালায়ে গেছি। পরে হামলাকারীরা যাবার পর বাড়ি ফিরে আসি।’

পুলিশ মোতায়েনের পরও কীভাবে এত বড় হামলা হলো জানতে চাইলে এসপি বিপ্লব কুমার সরকার জানান, যে কিশোরকে ঘিরে ঘটনার শুরু, তার বাড়ি গ্রামের দক্ষিণপাড়ায়। সন্ধ্যার পর থেকে মূলত ওই পাড়ায়ই থানা পুলিশ মোতায়েন ছিল।

এসপি বলেন, ‘সন্ধ্যা থেকেই ওই কিশোরের বাড়ির আশপাশে থানা পুলিশের সদস্যরা মোতায়েন ছিলেন। সেখানে পুলিশ ক্ষুব্ধ মানুষজনকে বোঝাতে চেষ্টা করে। ওই কিশোরকে আইনের আওতায় আনা হবে বলা হলে তারা শান্ত হয়ে চলে যায়। সে সময় পুলিশ দক্ষিণপাড়ায় অবস্থান করছিল। তবে রাতে উত্তরপাড়ায় হাজার হাজার মানুষ উগ্রবাদী স্টাইলে হামলা চালায়। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ সময় হামলাকারীদের রাবার বুলেট ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চলে।’

এসপি বিপ্লব আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে অনেক তথ্য এসেছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করছি। যাদের আটক করেছি, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। খুঁজে খুঁজে অন্য হামলাকারীদের বের করা হচ্ছে। যারাই এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে।’

ফেসবুকে আপত্তিকর কমেন্ট করা কিশোরকেও পুলিশ খুঁজছে জানিয়ে তিনি বলেন, ওই কিশোরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।

সোমবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান বিভাগীয় কমিশনার আবাদুল ওয়াহাব ভুঞা, রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য, জেলা প্রশাসক আসিব আহসানসহ প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন তারা।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে খাবার ও পোশাক বিতরণ করা হয়েছে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.