Sylhet Today 24 PRINT

পুলিশের সামনেই শিক্ষকের গলায় জুতার মালা

সিলেটটুডে ডেস্ক |  ২৬ জুন, ২০২২

'৩০ বছর ধরে আমি এই কলেজে শিক্ষকতা করি। ছাত্ররা আমার প্রাণ, স্থানীয়রাও আমাকে ভালোবাসত। তবু আমার সঙ্গে যা ঘটে গেল, এরপর এই মুখ নিয়ে কী করে আমি কলেজে যাব’- বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলছিলেন নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস।

ফেসবুকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে কলেজের এক হিন্দু শিক্ষার্থীর পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন দিনভর বিক্ষোভ, সহিংসতা চলে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।

এরপর পুলিশ পাহারায় বিকেল ৪টার দিকে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল ব্যক্তি। শিক্ষক স্বপন কুমার হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। পরে তাকে তুলে নেয়া হয় পুলিশের গাড়িতে।

মোবাইল ফোনে ধারণ করা এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পুলিশের সামনে শিক্ষকের এমন অপদস্ত হওয়ার ঘটনায় তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ।

ঘটনার পর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন স্বপন কুমার বিশ্বাস। প্রশাসনের দাবি, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে স্বপন কুমার জানিয়েছেন গত এক সপ্তাহে তিনবার ঠিকানা বদল করেছেন তিনি।

ঘটনার ভয়াবহতায় মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন স্বপন কুমার। এরপরেও তিনি জীবিকার প্রয়োজনে ফিরতে চান কলেজে।

ভারাক্রান্ত গলায় তিনি বলেছেন, ‘কলেজে গেলে নতুন করে আবার হামলা হয় কি না, সেই শঙ্কায় আছি। তারপরেও কলেজে ফিরতে চাই। কারণ আমার পরিবার আছে, সন্তান আছে, তাদের ভরণ-পোষণের খরচ আমাকে বহন করতে হয়। কলেজের চাকরিই আমার আয়ের উৎস।’

ফেসবুকে ভাইরাল ভিডিওতে শিক্ষক স্বপন কুমারের গলায় জুতার মালা পরানোর সময় আশপাশে পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেলেও তারা এখন দাবি করছে, এমন কোনো ঘটনা তাদের চোখে পড়েনি। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ওই ঘটনায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি তারা। শিক্ষক হেনস্তা বা কলেজে সহিংসতার ঘটনায় কোনো মামলাও হয়নি।

এরই মধ্যে কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পরিবর্তনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আক্তার হোসেন টিংকু। টিংকুর দাবি, আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য কবিরুল হক তাকে দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব করেছেন।

যেভাবে ঘটনার শুরু

ভারতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য করে সম্প্রতি ব্যাপক ক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে পড়েন বিজেপি নেতা নূপুর শর্মা। চাপের মুখে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি মামলাও হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় গত ১৭ জুন রাতে ফেসবুকে নূপুরকে প্রশংসা করে একটি পোস্ট দেন। রাহুলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন স্থানীয় মির্জাপুর হাজীবাড়ি দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মো. ওমর ফারুক।

ফারুক বলেন, ‘পরদিন শনিবার সকালে রাহুল কলেজে আসার পর বন্ধুরা পোস্টটি মুছে ফেলতে বললেও সে তা করেনি। এরপর বিষয়টি নিয়ে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের কাছে নালিশ জানায় কয়েকজন মুসলিম ছাত্র।’

বিষয়টি স্থানীয় পুলিশকে জানান কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। একপর্যায়ে এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফেসবুকে পোস্ট দেয়া ছাত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে কলেজ ক্যাম্পাসে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী।

কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘সকালে কিছু ছাত্র আমাকে ঘটনাটি জানালে আমি তিনজন শিক্ষককে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। তাদের মধ্যে ছিলেন কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক শেখ আকিদুল ইসলাম, পরিচালনা পরিষদের আরেক সদস্য ও কৃষি শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক কাজী তাজমুল ইসলাম। বাকি আরেক জন হলেন স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আক্তার হোসেন টিংকু।’

স্বপন কুমার বলেন, ‘কলেজের যেকোনো অঘটন ঘটলে আমি সব থেকে আগে এই তিন শিক্ষককে জানাই। প্রতিবারের মতো সেদিনও একইভাবে তাদের জানালাম।

‘স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেয়ার বিষয় নিয়ে আমি তাদের সঙ্গে আলোচনা করলাম। তবে তারা নীরব ছিলেন। কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

‘এরই মধ্যে কলেজে গুজব ছড়িয়ে পড়ে আমি ওই ছাত্রকে সাপোর্ট করছি। তখন কিছু ছাত্র কলেজে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।’

স্বপন কুমার বলেন, ‘একপর্যায়ে কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজন ও পাশের একটি মাদ্রাসার ছাত্ররা এসে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে। তখন আমি কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ অনেককে ফোন করে কলেজে ডেকেছি। তবে কেউ সময়মতো আসেননি।’

‘এরপর জড়ো হওয়া লোকজনের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। আমার মোটরসাইকেলসহ শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়।’

কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলেন, ‘পরে পুলিশ এসে আমাকে বলে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আপনাকে আমাদের হেফাজতে নিতে হবে। তখন আমি পুলিশের কাছে একটি হেলমেট ও বুলেট প্রুফ জ্যাকেট চাই। তবে আমাকে হেলমেট দেয়া হয়নি। একটি বুলেট প্রুফ জ্যাকেট দেয়া হলেও পরে তা পুলিশ খুলে নেয়।’

চূড়ান্ত হেনস্তার বর্ণনা দিয়ে শিক্ষক স্বপন কুমার বলেন, ‘পুলিশ আমাকে কলেজ কক্ষ থেকে বের করে আনে। তখন দুই পাশে শত শত পুলিশ ছিল। এর মধ্যেই স্থানীয়রা আমাকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরিয়ে দিল।

‘আমাকে পুলিশ ভ্যানের কাছে নেয়ার সময় পিছন থেকে অনেকে আঘাত করেন। আমি মাটিতে পড়ে যাওয়ায় পায়ের কিছু জায়গায় কেটে যায়। তখন অনুভব করি পিছন থেকে কেউ আমার মাথায় আঘাত করছে।’

পুলিশ ‘কিছু দেখেনি’

শিক্ষককে প্রকাশ্যে জুতার মালা পরিয়ে দেয়ার দৃশ্য ফেসবুকে ভাইরাল হলেও পুলিশের দাবি, তারা এ সম্পর্কে কিছু জানে না। এমনকি ঘটনার এক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরেও ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি দেখেননি জেলার পুলিশ সুপার। তার উল্টো অভিযোগ, পরিস্থিতি সামালে পদক্ষেপ নিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ‘দেরি’ করেছেন।

নড়াইল জেলা পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় বলেন, ‘ঘটনার দিন কলেজ প্রাঙ্গণের পরিস্থিতি খুব বেশি অস্বাভাবিক ছিল। পুলিশ সেখানে চেষ্টা করছিল বিনা রক্তপাতে পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।’

তিনি বলেন, ‘অধ্যক্ষকে যখন কলেজের কক্ষ থেকে বের করে আনা হয়, তখন সেখানে আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম। এ ছাড়া নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। তখন কেউ তাকে জুতার মালা দিয়েছে কি না, আমরা দেখতে পারি নাই। এটা আমার জানাও নেই।’

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমি এখনও কোনো ভিডিও দেখি নাই। জুতার মালার ব্যাপারটাও জানি না। এ ঘটনায় আমি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি। তারা প্রতিবেদন দিলে যে বা যারা দোষী হবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ঘটনার দিনের বর্ণনায় পুলিশ সুপার বলেন, ‘সেদিনের পরিস্থিতি খুবই বিপৎসংকুল ছিল। আমরা কোনো প্রকার গুলি চালাতে চাইনি, তবে ছয় রাউন্ড টিয়ারশেল ছুড়তে হয়েছে।’

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে নিয়ে প্রশ্ন তুলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘অধ্যক্ষের উচিত ছিল ওই দিন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া। কলেজ থেকে ওই ছাত্রের (ফেসবুকে পোস্ট দেয়া ছাত্র) বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা বিলম্ব করায় পরিস্থিতি এত খারাপ হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া গেছে।

‘স্থানীয়দের প্রচুর অভিযোগ ছিল অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। তবে আমরা তাকে দ্রুত রেসকিউ করতে চেয়েছিলাম।’

ফেসবুকে পোস্ট দেয়া ছাত্রের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার পর তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে কলেজে সহিংসতা ও শিক্ষককে হেনস্তার ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত পুলিশের কোনো পদক্ষেপ নেই। তারা বলছে, কলেজ বা অধ্যক্ষের পক্ষ থেকে মামলা না হওয়ার কারণেই বিষয়টিতে কোনো গতি নেই।

পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় বলেন, ‘অধ্যক্ষ এখন চাইলে মামলা দায়ের করতে পারেন। এ ছাড়া কলেজ কর্তৃপক্ষ চাইলেও মামলা দায়ের করতে পারে। আমরা বার বার তা বলে আসছি, কিন্তু কেউ এখনও রাজি হয়নি।

‘এ বিষয়ে আরও অধিক তদন্ত করতে পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল করা হয়েছে। সেই প্রতিবেদন পেলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।’

এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন থেকে সেখানে ২১ সদস্যের পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। এ ছাড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশ সেখানে নিয়মিত টহল দিচ্ছে। আশা করি এরপর আর পরিস্থিতি খারাপ হবে না।’

পুলিশের পক্ষ থেকে শিক্ষক স্বপন কুমারের নিরাপত্তা জোরদারের দাবিও করা হয়েছে। নড়াইল সদর থানার ওসি মোহাম্মদ শওকত কবীর বলেন, ‘অধ্যক্ষের কোনো অপরাধ না থাকায় তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। তাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাও দেয়া হচ্ছে।

‘তবে রাহুল নামের ওই ছাত্রের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। বর্তমানে সে কারাগারে আছে। কলেজে ও ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা আছে। এখন পরিস্থিতি শান্ত।’

স্বপন কুমারকে জুতার মালা পরানোর ভিডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘ওই দিন পাবলিক খুব বেশি উত্তেজিত ছিল। তাদের কন্ট্রোলে নেয়া যাচ্ছিল না। আর আমার চোখে জুতার মালার মতো কোনো কিছু পড়েনি। তাকে যখন গাড়িতে তোলা হয়েছে তখন তার গলায় এ ধরনের কিছু ছিল না।’

এদিকে পুলিশ নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি করলেও হেনস্তার শিকার শিক্ষক এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ঠিকানায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

স্বপন কুমার শনিবার মোবাইল ফোনে বলেন, ‘শনিবার (১৮ জুন) বিকেলে আমাকে থানায় নেয়া হয়। পরের দিন সন্ধ্যায় জানানো হয়, আমাকে বাড়িতে পাঠানো হবে। আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, কোথায় যেতে চাই। তখন আমি আমার কলেজের এক শিক্ষকের গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিই। তখন নিরাপত্তার জন্য পুলিশ সঙ্গে ছিল।

‘২৩ তারিখে তাদের বাড়ি থেকে নড়াইল সদরের একটি গ্রামে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছি। লোকলজ্জা ও হামলার ভয়- দুটিই কাজ করছে। তাই পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’

স্বপন কুমারের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে বর্তমান অবস্থানের সুনির্দিষ্ট তথ্য নিউজবাংলা প্রকাশ করছে না।

দায়িত্ব হারানোর মুখে স্বপন কুমার

দেড় বছর ধরে স্বপন কুমার বিশ্বাস মির্জাপুর ইউনাইডেট ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন। তবে ১৮ জুনের ঘটনার পর তাকে এই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

ঘটনার পরদিন ১৯ জুন নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক কলেজে এসে স্থানীয়দের সঙ্গে সভা করেন। সেখানে নতুন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করার বিষয়টি আলোচিত হয়।

কলেজের প্রধান সহকারী খান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এমপি কবিরুল হক সভা করে দোষীর শাস্তির আশ্বাস দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি পরিস্থিতি বিবেচনায় কলেজ বন্ধ রাখতে অনুরোধ করেছেন।

‘কলেজ খোলার পর পুনরায় সভা হবে। ওই সভায় হয়তো নতুন কোনো শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে।’

কলেজের একজন শিক্ষক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘কলেজের পরিচালনা পরিষদের কমিটি নতুন কাউকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ এলাকার মানুষ স্বপন কুমারকে এ দায়িত্বে দেখতে চাচ্ছে না। কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আক্তার হোসেন টিংকু হয়তো নতুন দায়িত্ব পাবেন।’

জেলা প্রশাসন ৪ জুলাই পর্যন্ত কলেজ না খুলতে নির্দেশ দিয়েছে।

নতুন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হতে এমপি ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের কয়েকজনের কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আক্তার হোসেন টিংকু।

তবে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে একেবারে না করে দিয়েছি। আমি চাই যিনি দায়িত্বে আছেন তিনিই থাকুন।’

ঘটনার দিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পরামর্শের জন্য ডাকার পর কেন নীরব ছিলেন জানতে চাইলে আক্তার হোসেন বলেন, ‘আমি সেদিন নীরব ছিলাম না। আমি চেয়েছিলাম যে দোষীর শাস্তি হোক।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরানো কাউকে চিনতে পেরেছেন কি না- এমন প্রশ্নে আক্তার হোসেনের দাবি, তিনিও এমন কোনো ঘটনা দেখেননি।

তিনি বলেন, ‘জুতার মালা পরানোর ঘটনাটি আমি নিজে দেখি নাই। ওই সময় সেখানে পুলিশ ছিল। তারা ভালো বলতে পারবে। আমি আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রটেক্ট করতেছিলাম। সে সময় আমার গায়ে বেশ কয়েকটি ইটপাটকেল লেগেছে। আমি দোষীদের শাস্তি চাই।’

কলেজের পক্ষ থেকে মামলা করার দায়িত্ব নিতেও রাজি নন আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, ‘এটা এখন একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসন বিষয়টির তদন্ত করছে। এ ছাড়া কলেজ খুললে আমরা শিক্ষকরা আলোচনা করে দেখব কী করা যায়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, মাসখানেক আগে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পাঁচজন কর্মচারী নিয়োগের চেষ্টা চালায় কলেজের প্রভাবশালী একটি চক্র। এতে বাধা দেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। এরপর থেকেই চক্রটির তোপের মুখে আছেন তিনি।

স্বপন কুমারকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে নড়াইলের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কলেজটি ঈদুল আজহা পর্যন্ত বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঈদের পর কলেজ রান করতে নতুন করে একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। কে দায়িত্ব পাবেন সে ব্যাপারে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেবেন।’

স্বপন কুমারকে দায়িত্ব থেকে সরানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সাময়িক সময়ের জন্য করা হচ্ছে। এটা শাস্তিমূলক কিছু না। আপাতত কলেজ ও এলাকার পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য এটা করা হচ্ছে।

‘এ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তাকে কিছুদিনের জন্য ছুটিতে রাখা হতে পারে।’

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘ওই দিনের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জুবায়ের হোসেন চৌধুরীকে। বাকি দুজন হলেন জেলা শিক্ষা অফিসার এস এম ছায়েদুর রহমান ও নড়াইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ শওকত কবীর।

‘২৩ জুন এ কমিটি গঠনের পর তারা কাজ শুরু করেছে। ৩০ জুন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে ঘটনায় কারা জড়িত তা জানা যাবে। এর আলোকে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া জেলা পুলিশের পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।’

বিষয়টি নিয়ে জানতে নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হককে ফোন করলে তিনি দাবি করেন, স্বপন কুমারকে দায়িত্ব থেকে সরানোর তথ্য সঠিক নয়। নতুন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হতে তিনি আক্তার হোসেন টিংকুকে কোনো প্রস্তাবও দেননি।

কবিরুল হক বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক একটা ঘটনা এখানে ক্যানসার হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তেজিত জনতা যেন আবারও উত্তেজিত না হয়, সে জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।

‘আমি সেদিনের ঘটনাটির নিন্দা জানাই। ঘটনার দিন আমাকে জানানো হয়েছিল। তখন আমি পার্লামেন্টে ছিলাম। রাতেই রওনা দিয়ে নড়াইলে এসেছি। পরের দিন কলেজে গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যা যা করার দরকার করেছি।’

অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরানোয় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি ভিডিওটি দেখি নাই। আমাকে বলা হয়েছে শুধু ছাত্রকে জুতার মালা পরানো হয়েছে।’

এসব বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার ‘পরামর্শ’ দেন এমপি কবিরুল। তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে যদি আবার নিউজ করেন, তখন বাইরের দেশে মিডিয়াও নিউজ করা শুরু করবে। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।’

সূত্র: নিউজ বাংলা

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.