Sylhet Today 24 PRINT

অভিজিৎ-অনন্ত হত্যা: আনসারুল্লাহর ৩ জঙ্গি রিমান্ডে

সিলেটটুডে ডেস্ক |  ১৯ আগস্ট, ২০১৫

বিজ্ঞান লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ও অর্থের যোগানদাতা হিসেবে আটক আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তিন জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে সাত দিনের রিমাণ্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।

ঢাকার মহানগর হাকিম শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান বুধবার তিনজনের জামিন আবেদন নাকচ করে এই আদেশ দেন।

এই তিন আসামি হলেন- মো. তৌহিদুর রহমান (৫৮), সাদেক আলী মিঠু (২৮) ও আমিনুল মল্লিক (৩৫)। এদের মধ্যে তৌহিদুর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক, যাকে হত্যাকাণ্ডের অন্যতম পরিকল্পনাকারী বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

র‍্যাবের বলছে, গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় একুশে বই মেলায় ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডে মোট পাঁচ জনের একটি দল অংশ নিয়েছিল এবং আড়াই মাস পর তারাই সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসকে হত্যা করে।

তিন আনসারুল্লাহ সদস্যকে বুধবার হাকিম আদালতে হাজির করে অভিজিৎ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয় গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে।

তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. ফজলুর রহমান রিমান্ডের আবেদনে বলেন, হত্যাকাণ্ডে আর কারা অংশ নিয়েছিল, কাদের ইন্ধনে ও অর্থায়নে এ অপরাধ ঘটেছে তা জানতে এবং হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের জন্য তিন আসমিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

এ সময় তৌহিদুর রহমানের আইনজীবী এ এল এম কামাল উদ্দিন হাফেজ রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করে জামিন চান।

তিনি বলেন, তার মক্কেলকে গত ২৮ মে আটক করা হলেও এতোদিন আদালতে তোলা হয়নি। তৌহিদ একজন বৃটিশ নাগরিক এবং মানসিক ‘ভারসাম্যহীন’ বলে তিনি দাবি করেন।

“তিনি রাস্তায় লোকজনকে নামাজ পড়ার জন্য বা ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণের জন্য দাওয়াত দেন। তিনি কোনো হত্যাকাণ্ডে জড়িত নন। তার দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার বিষয়ে ধানমন্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করা হয়েছিল।”

এ সময় বিচারক বলেন, “যদি দীর্ঘদিন আটক থাকার এই ঘটনার সত্যতা থাকে, তবে আমি ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আপনি সাক্ষী থাকবেন।” পরে তৌহিদুরের আইনজীবী এ বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করেন এবং তার বক্তব্য থেকে সরে আসেন।

বাকি দুই আসামি আদালতকে বলেন, তাদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। গণমাধ্যমের সামনে বলার জন্য তাদের কথা ‘শিখিয়ে দেওয়া’ হয়েছিল।

রিমান্ডের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু।

এর আগে মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতারের পর র‍্যাবের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছিল ব্লগার অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডে পাঁচ জঙ্গির একই দল অংশ নিয়েছিল। তার মধ্যে রমজান ও নাঈম সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল।

র‍্যাব পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানিয়েছেন- ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন রমজান ওরফে সিয়াম ও নাঈম।

এ হত্যাকাণ্ডের কিলিং মিশনের বাকি তিন সদস্য ছিলেন জুলহাস বিশ্বাস, জারফান আল হাসান ও সাদেক আলী। তাদের মধ্যে সাদেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিরা পলাতক রয়েছেন।
অভিজিৎ হত্যাকারী এ ৫ জনই একইভাবে সিলেটের অনন্ত দাশ বিজয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটান।

মঙ্গলবার (১৮ আগস্ট) দুপুরে র‍্যাব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।

ব্লগার অভিজিৎ রায় ও অনন্ত দাশ বিজয় হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও মূল অর্থ যোগানদাতাসহ মোট তিন জনকে সোমবার (১৭ আগস্ট) রাতে রাজধানীর নীলক্ষেত ও ধানমণ্ডি এলাকায় অভিযান চালিয়ে আটক করে র‍্যাব। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে সে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

আটককৃতরা হলেন তৌহিদুর রহমান, সাদেক আলী ও আমিনুল মল্লিক। তাদের মধ্যে তৌহিদুর অর্থ যোগানদাতা। আর সাদেক ও আমিনুল হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী। তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য বলে জানিয়েছে র‍্যাব।

র‍্যাব পরিচালক জানান, তৌহিদুর রহমান মূলত জসিম উদ্দিন রাহমানির (বর্তমানে কারাগারে আটক আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সংগঠক) অনুপস্থিতিতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আর্থিক বিষয় দেখাশোনা এবং সকল হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করতেন। তিনি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী, কিন্তু ব্রিটিশ নাগরিক এবং যুক্তরাজ্যের একজন আইটি বিশেষজ্ঞ বলেও জানায়  র‍্যাব।

জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা গেছে, তৌহিদুর রহমান অভিজিৎ ও অনন্ত বিজয় হত্যাকাণ্ডের কার্যক্রম ও সকল গতিবিধি নজর রাখতেন।

র‍্যাব পরিচালক জানান- নব্বইয়ের দশকে তৌহিদুর যুক্তরাজ্যে গমন করেন এবং আইটি বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে জসিম উদ্দিন রাহমানির মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সংগঠনের সার্বিক ও আর্থিক বিষয় পরিচালনা করে আসছেন।

মুফতি মাহমুদ খান আরও জানান, তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, জসিম উদ্দিন রাহমানির কাছ থেকে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সব ধরনের নির্দেশনা আসতো। আটককৃত সাদেক আলীর সঙ্গে ২০০৭ সালে জসিম উদ্দিন রাহমানির পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তিনিও জসিম উদ্দিনের মতাদর্শে ‍অনুপ্রাণিত হয়ে সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ও তার স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
আটককৃত অপর আসামি আমিনুল মল্লিকও আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সক্রিয় সদস্য। তিনি সংগঠনের সকল সদস্যকে আত্মগোপনে ও পালিয়ে দেশের বাইরে যেতে তাদের নামে পাসপোর্ট তৈরি করে দিতেন।

জেল থেকে রাহমানির কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে মিঠু ও তার আপন ছোট ভাই আবুল বাশারের মাধ্যমে বিভিন্ন সদস্যকে সরবরাহ করতেন সাদেক আলী।

মুফতি জানান, অভিজিৎ হত্যাকারী এ ৫ সদস্য একইভাবে সিলেটের অনন্ত দাশ বিজয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন বলেও স্বীকার করেছেন আটককৃতরা।

মুফতি মাহমুদ জানান, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের তিন ঘণ্টা আগে তারা মহসীন হলের সামনে বৈঠক করেন। এরপর সবাই বইমেলায় অবস্থান নেন। পরে অভিজিৎ মেলা থেকে বের হলে সময় সুযোগ বুঝে রমজান ও নাঈম সরাসরি ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তাকে হত্যা করেন।

জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা গেছে, রমজান কালোজিরা ও মধু বিক্রেতার ছদ্মবেশে রাজধানীতে ঘুরে বেড়ান। এ হত্যাকাণ্ডের পর তৌহিদুর রহমানের নির্দেশে সাদেকসহ জুলহাস ও জাফরানের দায়িত্ব ছিলো অনলাইনের মাধ্যমে আনসারুল্লাহ বাংলা-১ থেকে শুরু করে বিভিন্ন নামে দায় স্বীকার করা।

উল্লেখ্য, এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন টিএসসিতে আসার পর অভিজিৎ রায়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গি মৌলবাদীরা।

ঘটনাস্থলে অভিজিৎ রায় মৃত্যুবরণ করেন, তাঁর সঙ্গে থাকা স্ত্রী বন্যা আহমেদও আক্রমণের শিকার হন। মৌলবাদীদের চাপাতির কোপে তিনি হাতের আঙুল হারান।

ঘটনার পর অভিজিৎ রায়ের পিতা শিক্ষাবিদ অজয় রায় বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা খুনীদের আসামি করা হয়।

অভিজিৎ রায়ের মামলা তদন্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ঢাকায় আসে। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন সহ স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে মামলার আলামত সংগ্রহ করে। অদ্যাবধি তাদের রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।

এদিকে, গত ১২ মে সিলেটের সুবিদবাজারস্থ বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে জঙ্গি মৌলবাদীদের চাপাতির আঘাতে খুন হন আরেক ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। অভিজিৎ রায়ের মতো তাঁকেও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গি মৌলবাদীরা।

ঘটনায় অনন্তর ভাই রত্নেশ্বর বাদী হয়ে স্থানীয় থানায় মামলা করেন। কোন কুলকিনারা না হওয়ায় ঘটনার ১৩ দিন পর মামলা ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। এ মামলায় পুলিশ স্থানীয় এক পত্রিকার ফটো সাংবাদিক ইদ্রিস আলীকে গ্রেফতার করে।

অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় দাশ লেখালেখির কারণে দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি মৌলবাদীদের হুমকি পেয়ে আসছিলেন।

গত ছয় মাসে বাংলাদেশে অভিজিৎ রায় (২৬ ফেব্রুয়ারি), ওয়াশিকুর রহমান বাবু (৩০ মার্চ), অনন্ত বিজয় দাশ (১২ মে), নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নীল (নিলয় নীল) (৭ আগস্ট) নামের চার জন ব্লগার খুন হন কিন্তু পুলিশ কোন মামলার কুলকিনারা করতে পারেনি। হত্যাকাণ্ডের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আল-কায়েদা উপমহাদেশীয় শাখা দায় স্বীকার করে।

এর আগে আহমেদ রাজীব হায়দারকে (২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি) খুন করে মৌলবাদীরা। রাজীব হায়দারের মামলা বিচারের পর্যায়ে রয়েছে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.