Sylhet Today 24 PRINT

এখনও শুরু হয়নি চূড়ান্ত বিচার

২১ আগস্টের গ্রেণেড হামলার ১৫ বছর

সিলেটটুডে ডেস্ক |  ২১ আগস্ট, ২০১৯

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে চালিত গ্রেনেড হামলা মামলার চূড়ান্ত বিচার শুরু হয়নি এখনও। হাইকোর্টে এ মামলা দ্রুত শুনানির জন্য আনুমানিক ৫০টি পেপারবুক তৈরি করা প্রয়োজন, যার একেকটি ৫০ হাজার পৃষ্ঠারও বেশি হতে পারে।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের অনুমোদন পাওয়া গেলে এসব পেপারবুক তৈরি করা হবে। তবে সে ক্ষেত্রেও কমপক্ষে ছয় থেকে আট মাস সময় লাগতে পারে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলছেন, এ ব্যাপারে শিগগিরই প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।

ভয়াবহ এই গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন।

আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। এ ঘটনার ১৪ বছর পর গত বছরের ১০ অক্টোবর বহুল প্রত্যাশিত রায় দেন ঢাকার বিচারিক আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামির করা আপিল হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। বিচারিক আদালতের রায়ে এ মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আইনি প্রক্রিয়ায় সরকার ইতিহাসের বর্বরোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার দ্রুত কার্যকর করতে চায়। এ জন্য এই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ও পলাতক সব আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, গ্রেনেড হামলা মামলার রায় কার্যকরের জন্য এখন দ্রুত পেপারবুক তৈরি করা প্রয়োজন। শিগগিরই প্রধান বিচারপতির কাছে এ মামলাটি অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত পেপারবুক তৈরির জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। প্রধান বিচারপতির অনুমোদন পাওয়া গেলে মামলার পেপারবুক তৈরির কাজ দ্রুত শুরু হবে বলেও আশা করেন তিনি।

মাহবুবে আলম বলেন, এর আগে পিলখানা বিডিআর হত্যা মামলায়ও প্রধান বিচারপতির নির্দেশে বিশেষ ব্যবস্থায় পেপারবুক তৈরি হয়েছিল। গ্রেনেড হামলা মামলায়ও যাতে বিশেষ ব্যবস্থায় পেপারবুক তৈরি করা হয়, সে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তিনি জানান, পেপারবুক প্রস্তুত হলেই ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও সাজার বিরুদ্ধে আসামিদের করা আপিলের শুনানি শুরু হবে।

সুপ্রিম কোর্টের ফৌজদারি শাখা সূত্রে জানা গেছে, গ্রেনেড হামলা মামলা রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর দণ্ডিতদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৭ আসামি ৩৪টি ও যাবজ্জীবন দদালতের দেওয়া সাজার রায় বাতিল চাওয়া হয়েছে।

পেপারবুক কেন প্রয়োজন :ফৌজদারি কার্যবিধির ৩১ ধারা অনুযায়ী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকরা যে কোনো দন্ড দিতে পারেন। তবে কেবল মৃত্যুদন্ড দিলে সেটি হাইকোর্টে অনুমোদন করাতে হয়। তাই বিচারিক আদালত রায়ের পর ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মামলার সব নথি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন, যা 'ডেথ রেফারেন্স' নামে পরিচিত। এ নথি আসার পর হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা মামলার পেপারবুক তৈরি করেন, যা তৈরি হলেই মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

আইনজীবীরা বলছেন, বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আসামিরা আপিল ও জেল আপিল করার সুযোগ পান। ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে। ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক তৈরি করতে হয়। পেপারবুকে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, জব্দ তালিকা, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও বিচারিক আদালতের রায় পর্যায়ক্রমে সাজানো থাকে।

গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে। তাই হাইকোর্টে এ মামলার বিচারে কমপক্ষে ৪৬ থেকে ৫০টি পেপারবুক তৈরি করা প্রয়োজন। এর একেকটি ৫০ হাজার পৃষ্ঠারও বেশি হতে পারে। কারণ, গ্রেনেড হামলার দুটি মামলার মূল নথি ও রায় ৩৮ হাজার ১১০ পৃষ্ঠার। যার মধ্যে হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় ৩৬৯ পৃষ্ঠার। তা ছাড়া একই ঘটনায় করা বিস্ম্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় ৩৫৬ পৃষ্ঠা।

এ বিষয়ে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান বলেন, হাইকোর্টের বিধি অনুসারে প্রতি পৃষ্ঠা ১৬-১৭ লাইনের মধ্যে হতে হবে। সে হিসেবে ৩৮ হাজার পৃষ্ঠার মূল নথি ও রায়ের সঙ্গে হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আবেদনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক নথিপত্র যুক্ত হবে। তিনি জানান, হাইকোর্টের দুই বিচারক, রাষ্ট্রপক্ষ ও ৩৮ আসামির প্রত্যেক আইনজীবীই একটি করে পেপারবুক পাবেন। এর সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনসহ অন্যান্য শাখাও যুক্ত হবে। এ কারণে এ মামলার বিচারের জন্য কমপক্ষে ৪৬-৫০টি পেপারবুক তৈরি করা লাগতে পারে।

গ্রেনেড হামলার পেপারবুক তৈরি প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র হাইকোর্টের স্পেশাল অফিসার মো. সাইফুর রহমান বলেন, প্রধান বিচারপতির অনুমোদন সাপেক্ষে গুরুত্বপূর্ণ মামলার পেপারবুক সুপ্রিম কোর্ট নিজেই ছাপিয়ে থাকে। নয়তো বিজি প্রেসের মাধ্যমে ছাপানো হয়। তবে গ্রেনেড হামলা মামলার পেপারবুক কোথায় তৈরি হবে, সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পেলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করা হবে। তিনি জানান, গ্রেনেড হামলা মামলার পেপারবুক তৈরির জন্য স্বাভাবিক নিয়মে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের দু'জন মুদ্রাক্ষরিক নথিপত্র টাইপ শুরু করেছেন। এটি শেষ হওয়ার পর তা মূল নথির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে। এরপর কোথায় পেপারবুক ছাপা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে ফাইল উপস্থাপন করা হবে।

মামলা নিষ্পত্তিতে বিশেষ বেঞ্চ :সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, হাইকোর্টে বর্তমানে ২০১৪ সালের ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি চলছে। হাইকোর্টের তিনটি বিশেষ বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলোর শুনানি ও নিষ্পত্তি করা হয়। গ্রেনেড হামলার মামলাটি ২০১৮ সালে হাইকোর্টে নথিভুক্ত হওয়ায় ক্রমানুসারে আরও পাঁচ বছর পর শুনানির জন্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় আসার কথা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পেপারবুক তৈরির পর বিশেষ বেঞ্চে দ্রুত এ মামলার শুনানির উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ।

ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, শুধু পেপারবুক তৈরি করলেই হবে না। দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ বেঞ্চও গঠন করতে হবে। তিনি প্রধান বিচারপতির পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে বলেন, ডেথ রেফারেন্সসহ আরও যেসব মামলা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারেও প্রধান বিচারপতির পদক্ষেপ প্রয়োজন। কারণ, বিচারের বিলম্ব বিচারপ্রার্থীর জন্য চরম বেদনাদায়ক। সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুযায়ী, ৭০৬টি মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক হাজার ছয়শ'র বেশি আসামির আপিল বর্তমানে উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

পরিপ্রেক্ষিত :২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ম্ফোরক আইনে পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় দুটি মামলা করে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এ ঘটনার প্রথম থেকেই হামলাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সাজানো হয় 'জজ মিয়া' নাটক। তবে সময়ের পরিক্রমায় ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেনেড হামলা মামলার পুনর্তদন্ত শুরু হলে বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক তথ্য। তদন্ত শেষে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন দুই মামলায় অভিযোগপত্র দেন। এতে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। ২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ নিয়ে মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২।

আসামিদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামী নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় হুজি নেতা আবদুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ফলে এ মামলা থেকে তাদের নাম বাদ পড়েছে। এরপর দুটি মামলায় শুনানি শেষে গত বছরের ১০ অক্টোবর সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে 'ডাবল' মৃত্যুদ দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। দি তদের মধ্যে অধিকাংশই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতা। একই অপরাধে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে 'ডাবল' যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত। আসামিদের মধ্যে ১৮ জন পলাতক বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

রায়ে বলা হয়, এ হামলার প্রস্তুতিপর্বে হাওয়া ভবনের বৈঠকে তারেক রহমান জঙ্গিদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। হামলার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। গত বছরের ২৭ নভেম্বর বিচারিক আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। তারপর তা হাইকোর্টে পাঠানো হয়।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.