সিলেটটুডে ডেস্ক | ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
মানব ও অর্থ পাচারের দায়ে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলকে সাজা দিয়ে রায়ের কপি জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে পাঠানো হয়েছে।
সরকারদলীয় একজন হুইপ জানিয়েছেন, সব কাগজপত্র চলে আসায় পাপুলের সংসদ সদস্য পদ বাতিল এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।
শুক্রবার রাজধানীর পূর্বাচল ক্লাবে এক অনুষ্ঠান শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানান, পাপুলের সাজার রায়ের কপি তাদের হাতে এসেছে।
কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছ থেকে আসা কপির একটি অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তিনি বলেন, ‘পাপুলের রায়টা আমরা পেয়েছি। ৬১ পৃষ্ঠার রায়। এটি দুটো ভাষায় আরবি এবং ইংরেজি আমরা পেয়েছি। আমরা আইন অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মাননীয় স্পিকারের কাছে এগুলো পৌঁছে দিয়েছি। বাকি অ্যাকশন (ব্যবস্থা) তারা নেবে।’
গত বছরের ৬ জুন পাপুলকে আটক করে কুয়েত সরকার। সে দেশে তার ব্যবসা রয়েছে। মারাফি কুয়েতিয়া কোম্পানির অন্যতম মালিক পাপুলের সেখানে বসবাসের অনুমতি রয়েছে।
পাচারের শিকার পাঁচ বাংলাদেশির অভিযোগের ভিত্তিতে পাপুলের বিরুদ্ধে মানব পাচার, অর্থ পাচার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগ মামলা করা হয়।
সে সময় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার খবর প্রকাশ হলেও স্পিকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।
গত ২৮ জানুয়ারি কুয়েতের আদালত তাকে কারাদণ্ড দেয় বলে গণমাধ্যমের খবরে আসে। সেই সঙ্গে তাকে ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার জরিমানা করে দেশটির একটি আদালত। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৫৩ কোটি টাকারও বেশি।
পরদিন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি আমরা এখনো পেপার পত্রিকাতেই দেখেছি। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানার চেষ্টা করছি। এরপর আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
স্পিকারকে রায়ের কপি পাঠিয়ে দেয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা রায়ের ভারডিক্টটা (রায়) পেলাম। আমাদের দেশের মতো কুয়েতেও ভারডিক্ট আসতে অনেক দেরি হয়, লিখতে অনেক সময়। আমরা এটা নিয়ে পেরেশানিতে ছিলাম। আপনাদের মিডিয়া প্রায়ই গিয়ে এটা নিয়ে জানতে চান, স্পিকারও প্রায়ই এটা নিয়ে ফোন করেন। আমাদের রাষ্ট্রদূতকে বলি, যাতে আমরা রায়টা তাড়াতাড়ি পেতে পারি। রায় আসার পরপরই আমরা যথাস্থানে পাঠিয়ে দিয়েছি।
‘আমরা জাতীয় সংসদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। বাকিটুকু তারা সিদ্ধান্ত নেবে। তারা আইনবিধি মোতাবেক কাজ করবে। এটা আমার বলে লাভ নাই। এটা সংসদের একটা নীতি আছ, সেই নীতি অনুয়ায়ী তারা ব্যবস্থা নেবে।’
এর আগে মন্ত্রী বলেছিলেন, পাপুল বাংলাদেশি নাগরিক বিধায় সরকার তার পাশে থাকবে।
পাপুল সরকারের কাছে আইনি সহায়তা চেয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি কোনো আইনি সহায়তা চান নাই। ওখানে তিনি ব্যবসায়ী হিসেবে থাকেন এবং আমাদের কোনো ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট নিয়ে যাননি। আমাদের মিশনের কোনো সাহায্য তিনি চাননি। কারণ ওনার নিজেরই ভালো অবস্থান রয়েছে সেখানে। ওনার পাসপোর্ট ভিআইপি পাসপোর্ট।’
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী পাপুল আর সংসদ সদস্য থাকতে পারেন না।
শাসনতন্ত্রের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি আর সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হন না।
তবে এই সংসদ সদস্য পদ বাতিলের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে বলা আছে, সংসদ সদস্য কোনো ফৌজদারি অভিযোগে গ্রেপ্তার হলে বা আদালতে দণ্ডিত হলে বা কোনো নির্বাহী আদেশ আটক হলে, গ্রেপ্তারকারী বা দণ্ডদানকারী বা আটককারী কর্তৃপক্ষ বা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী কর্তৃপক্ষ যথাযথ ফরমে গ্রেপ্তার, দণ্ডাদেশ বা আটকের কারণসহ পুরো বিষয় স্পিকারকে জানাবে।
একইভাবে গ্রেপ্তার হয়ে দণ্ডপ্রাপ্তির পর আপিলের বিবেচনা সাপেক্ষে জামিনে মুক্ত হলে বা অন্যভাবে মুক্ত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একইভাবে স্পিকারকে অবহিত করবে।
এখন সরকারের হাতে রায়ের কপি আসায় এবং সেটি স্পিকারের দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এমপি পদ হারাচ্ছেন পাপুল
জাতীয় সংসদের হুইপ নূর ই আলম চৌধুরী বলেন, আমাদের আইনে তার আর সংসদ সদস্য থাকার সুযোগ নেই। কোনো আইনি ব্যত্যয় ঘটবে না। পার্লামেন্ট এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
এখন তো সংসদ অধিবেশনে নেই। তাহলে সিদ্ধান্ত কি ঝুলে থাকবে?- এমন প্রশ্নে হুইপ বলেন, ‘সংসদ অধিবেশনে না থাকলেও সংসদ সচিবালয় আছে। আছে স্পিকারের দপ্তরও। তারা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
পাপুল যেভাবে সংসদ সদস্য
সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কুয়েতে যাওয়ার কয়েক দশকের মধ্যে ধনকুবের হয়ে যাওয়া পাপুল একাদশ সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য হন।
সে সময় তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয় বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল।
তবে ভোটের আগে আগে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ নোমান সরে দাঁড়ান। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পাপুলের পক্ষে কাজ করেন।
পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলামও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সংসদের আসন বণ্টনের হিসাবে নারী আসনের একটি পেয়েছিলেন এবং তারা সেলিনাকে মনোনয়ন দেন।
পাপুলের স্ত্রীও আসামি
পাপুলের পাশাপাশি তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম মেয়ে ওয়াফা ইসলাম ও শ্যালিকা জেসমিন প্রধানও অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচার মামলার আসামি।
দুর্নীতি দমন কমিশন গত ১১ নভেম্বর মামলাটি করে। এই মামলায় সেলিনা এবং ওয়াফা গত ২৭ ডিসেম্বর জামিন পান।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, জেসমিন প্রধান দুই কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৮ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
‘কাগুজে প্রতিষ্ঠান’ করে তিনি ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৪৮ কোটি টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করেছেন বলেও বলা হয় মামলায়।
বলা হয়, এসব কাজে পাপুল, তার স্ত্রী ও মেয়ে সহযোগিতা করেছেন।
পাপুল কুয়েতে গ্রেপ্তারের পর গত বছরের ২২ জুলাই সেলিনা ইসলাম ও জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।
সেলিনা ইসলাম এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলাম ও শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের আট ব্যাংকের ৬১৩টি হিসাব জব্দও করেছে দুদক।
তাদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা ৩০ দশমিক ২৭ একর জমি ও গুলশানের ফ্ল্যাট বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে দুদক। এজন্য সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়েও চিঠি দিয়েছে কমিশন।