Sylhet Today 24 PRINT

আরিফকে ঠেকাতেই কি এত কৌশল, প্রশ্ন বিএনপিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ২৫ মার্চ, ২০২২

সিলেট জেলা বিএনপির সম্মেলনে সভাপতি পদে সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর প্রার্থী হওয়াই ছিল বড় চমক। তবে তারচেয়েও চমকে দিয়েছে তার দল বিএনপি। বিএনপির কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করানো হয়েছে আরিফের। তার আগে হঠাৎ স্থগিত করা হয় কাউন্সিল ও সম্মেলন। এরপর বাড়ানো হয়েছে প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের তারিখ। আর আরিফুল হক মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিনই সম্মেলনের নতুন তারিখ নির্ধারণ করেছে জেলা বিএনপি।

এমন কর্মকাণ্ডে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যেই প্রশ্ন ওঠে, আরিফকে ঠেকাতেই কি বিএনপি এত কৌশল নিয়েছে? একইভাবে আরও তিনি নেতা কামরুল হাসান শাহীন, আব্দুল আহাদ খান জামাল ও শাকিল মোর্শেদের প্রার্থিতা বাতিলের বিষয় নিয়েও আছে নানা আলোচনা।

আরিফ অনুসারী নেতারা জানান, জেলা বিএনপির সভাপতি পদে আরিফুল হক চৌধুরীর বিজয় আঁচ করতে পেরে তার বিরোধী বলয়ের নেতারা দলের হাইকমান্ডে প্রভাব বিস্তার করে সম্মেলন স্থগিত করান। এরপর কেন্দ্রের চাপে সভাপতি পদে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন আরিফ।

বিএনপি নেতাদের আরেক অংশ জানায়, সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে আরিফুল হক চৌধুরীর প্রতি বিএনপির হাইকমান্ড অসন্তুষ্ট। ১৬ মার্চ সম্মেলনের ঠিক চার দিন আগে আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়ায় আরিফের ওপর আরও রুষ্ট হয় দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। ফলে নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম হওয়ার প্রাক্কালে জেলা বিএনপির সভাপতি পদে আরিফকে দেখতে চায়নি হাইকমান্ড। এ কারণে আরিফের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানো হয়েছে।

তবে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন দাবি করেন, সঠিক সময়ে ভোটার তালিকা প্রকাশ না করায় জেলা বিএনপির কাউন্সিল স্থগিত করা হয়। এতে অন্য কোনো কারণ নেই।

আরিফের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে কেন্দ্রের নির্দেশনা প্রসঙ্গে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘উনি মেয়র পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। তাকে অনেক কিছু ম্যানেজ করে চলতে হয়। স্থানীয় সাংসদ ও মন্ত্রীদের সঙ্গে তাকে সুসম্পর্ক রাখতে হয়। তাই এই মুহূর্তে দলের দায়িত্ব নিলে তাকে এসব ম্যানেজ করতে সমস্যা হতে পারে। এতে দলের কার্যক্রমের পাশপাশি সিলেটের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। এসব কারণে তাকে সভাপতি পদে প্রার্থিতা থেকে সরে যেতে বলা হয়েছে।’

সিলেট জেলা বিএনপির সম্মেলন ও কাউন্সিল হওয়ার কথা ছিল ২১ মার্চ। কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচনের ঘোষণা দেয় দলটি। সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন করা হয়েছিল। সম্মেলন ঘিরে চাঙা হয়ে ওঠেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।

দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, এবার সম্মেলনে চমক সৃষ্টি হয় সভাপতি পদে সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রার্থী হওয়ায়। কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য আরিফ এর আগে মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। মহানগর বিএনপির সভাপতিও ছিলেন। এবারের জেলা কাউন্সিলে হঠাৎ করেই তিনি সভাপতি প্রার্থী হন। তার প্রার্থী হওয়া বদলে দেয় সিলেটে বিএনপির রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। দ্বিধাবিভক্ত বিএনপির রাজনীতিতে আরিফের প্রার্থী হওয়া পুরোনো বিরোধকে উসকে দেয়।

কয়েকজন নেতা জানান, সিলেটে বিএনপি এখন মূলত দুই ধারায় বিভক্ত। এক বলয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। অপর বলয়ের নেতৃত্বে আরিফ। তবে মুক্তাদির কেন্দ্রের শীর্ষ পদে থাকায় সিলেটে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কমিটিগুলোতে তার বলয়েরই আধিপত্য।

মুক্তাদিরের এই আধিপত্যে ভাঙন ধরাতেই আরিফ জেলা বিএনপির সভাপতি প্রার্থী হয়েছিলেন বলে জানান তারা। আবার কয়েকজন নেতা মনে করেন, মুক্তাদিরই দলের হাইকমান্ডে প্রভাব খাটিয়ে জেলার সম্মেলন স্থগিত করান।

সম্মেলনের এক দিন আগে ২০ মার্চ বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল কবির রিজভীর সই করা চিঠিতে সম্মেলন স্থগিতের নির্দেশনা দেয়া হয়।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবুল মোমেন ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে সখ্যের কারণে আরিফুল হক চৌধুরীর ওপর আগে থেকেই অসন্তুষ্ট ছিল বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ। দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয় থাকারও অভিযোগ রয়েছে মেয়র আরিফের বিরুদ্ধে।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে সম্মাননা দেয়ার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবুল মোমেনকে সংবর্ধনা দিয়েও নিজ দলে সমালোচিত হয়েছিলেন আরিফ।

তারা জানান, জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারবিরোধী শক্ত আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে দলকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে সখ্যের কারণে আরিফের পক্ষে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না, দলের হাইকমান্ড এমনই ভেবে থাকতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা আরও বলেন, ‘দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হয়তো মনে করেছে, নিজের ব্যক্তি ইমেজ, মেয়র পদ ও আর্থিক সক্ষমতা দিয়ে সভাপতি পদে আরিফুল হক জয়ী হয়ে যেতে পারেন। সরকার নানা মেকানিজম করেও তাকে জয়ী করে ফেলতে পারে। তাই কেন্দ্র থেকে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিতে বলা হয়েছে।’

এ ক্ষেত্রে খন্দকার মুক্তাদিরের ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে করেন তারা। তবে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির দেশের বাইরে থাকায় এ ব্যাপারে তার মন্তব্য জানা যায়নি।

এ বিষয়ে আরিফুল হক চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে মঙ্গলবার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই বিএনপির উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। আমার বিজয় ছিল সুনিশ্চিত।

‘বিএনপি দেশের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, সেই দলের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে আমার কাছে জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ব্যক্তির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।’

আরিফের মনোনয়নপত্র প্রত্যহারের পর জেলা বিএনপির সভাপতি পদে লড়াইয়ে আছেন শুধু আবুল কাহের চৌধুরী শামীম ও আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী।

নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কাছে মঙ্গলবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করেন আরিফ। ওইদিন রাতেই বৈঠক করে ২৯ মার্চ কাউন্সিলের নতুন তারিখ নির্ধারণ করে সিলেটে জেলা বিএনপি। কেন্দ্র মঙ্গলবারই এই প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রস্তাবনা অনুমোদন দিয়েছেন।

এদিকে, মঙ্গলবার নির্বাচন পরিচলানা কমিটির বৈঠকে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী কামরুল ইসলাম শাহীন ও সাংগঠনিক সম্পাদক প্রার্থী শাকিল মোর্শেদের মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। আগের দিন মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয় সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী আবদুল আহাদ খান জামালের।

ভোটার তালিকায় নাম না থাকায় কামরুল ইসলাম শাহীন ও শাকিল মোর্শেদের এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের পদে থাকায় আব্দুল আহাদ খান জামালের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে বলে জানান নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান আব্দুল গাফ্ফার।

এক প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার এবং তিন প্রার্থীর বাতিল হওয়ায় সিলেট জেলা বিএনপির তিন পদে লড়ছেন ৯ জন। এর মধ্যে দুই সভাপতি প্রার্থী ছাড়া সাধারণ সম্পাদক পদে আ. ফ. ম কামাল, আলী আহমদ, ইমরান আহমদ চৌধুরী ও মো. আব্দুল মান্নান এবং সাংগঠনিক সম্পাদক পদে এম মুজিবুর রহমান মুজিব, লোকমান আহমদ ও মো. শামিম আহমদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আব্দুল আহাদ খান জামাল বলেন, ‘অঙ্গসংগঠনের পদে থাকার কারণ দেখিয়ে আমার মনোয়ন বাতিল করা হয়েছে। অনেক উপজেলায় অঙ্গসংগঠনের পদে থাকা নেতারা বিএনপির শীর্ষ পদে ঠাঁই পেয়েছেন। আমার মনোনয়নপত্র অবৈধ হলে তারা কীভাবে পদ পেলেন?’

মনোনয়নপত্র বাতিলের নেপথ্যে ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলে মনে করেন আরেক সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী কামরুল ইসলাম শাহীন। তিনি বলেন, ‘আমি ওয়ার্ড পর্যায়ের বিএনপির সঙ্গেও জড়িত আছি, তবু আমার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। এর পেছনে ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য চিঠি দিয়েছি।’

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.