Sylhet Today 24 PRINT

বিদায় মহিউদ্দিন চৌধুরী

সিলেটটুডে ডেস্ক |  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

বীর মুক্তিযোদ্ধা, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে চট্টগ্রামস্থ চশমাহিলের পারিবারিক গোরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে। এরআগে, লালদীঘি ময়দানে শুক্রবার বিকেলে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জানাজায় লাখো মানুষের ঢল নামে। এ সময় আশপাশের সড়ক বিশেষ করে আন্দরকিল্লাহ থেকে জেল সড়ক, কেসি দে সড়ক, কোতোয়ালি মোড় পর্যন্ত ছিল মানুষ আর মানুষ।

জাতি-ধর্ম-দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন পেশার মানুষ মহিউদ্দিন চৌধুরীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে লালাদীঘি ময়দানে হাজির হন। ওই ময়দানসহ আশপাশের সড়কে ছিল মানুষ আর মানুষ।

বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে মরদেহবাহী গাড়িটি লালদীঘি ময়দানে পৌঁছায়। এরআগে বিকেল তিনটায় দারুল ফজল মার্কেটে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে গাড়িটি কিছুক্ষণ দাঁড় করানো হয়। জানাজাস্থলে লাল-সবুজ পতাকায় মোড়ানো মহিউদ্দিন চৌধুরীর মরদেহ গাড়ি থেকে নামানোর পর একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। এরপর বিকেল সোয়া ৪টায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

জানাজায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সাংসদ হাছান মাহমুদ, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য সাংসদ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, সাংসদ এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার, নগর বিএনপির সভাপতি শাহাদাত হোসেন প্রমুখ অংশ নেন।

পরে চশমাহিলের পারিবারিক কবরস্থানে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে নগরের ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহিউদ্দিন চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।

এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে। বাবা হোসেন আহমদ চৌধুরী এবং মা বেদৌরা বেগম। আট ভাইবোনের মধ্যে মহিউদ্দিন মেজ। বাবা চাকরি করতেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে।

বাবার চাকরিসূত্রে মহিউদ্দিন পড়াশোনা করেছেন মাইজদী জেলা স্কুল, কাজেম আলী ইংলিশ হাইস্কুল আর প্রবর্তক সংঘে। স্কুল জীবনেই জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। মাধ্যমিকের শেষে বাবার আদেশে ভর্তি হয়েছিলেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোর্সে। সেখানের পাঠ না চুকিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রামের অন্যতম বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজে। বছর না ঘুরতেই কমার্স কলেজ, পরে সিটি কলেজে। সিটি কলেজেই তার বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই সান্নিধ্যে আসেন জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন অসংখ্যবার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমি সদর দপ্তরের কাছে গ্রেপ্তার হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন।

তার গ্রেপ্তারের খবরে ততদিনে ভারতের একটি মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে শহিদ মহিউদ্দীন ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। বেঁচে থাকার কথা ছিল না তার। শহীদ ভেবে বাবা ছেলের নামে দিয়েছিলেন ফাতেহা। এরই মাঝে একদিন মানসিক রোগীর ভান করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে বের হন মহিউদ্দিন। পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে সম্মুখসমরে অংশ নেন।

দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন নতুন সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের আর আদরের ছাত্রনেতা ছিলেন মহিউদ্দিন।

কিছুদিন যেতে না যেতেই ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধুর। অল্পের জন্য মহিউদ্দিন ধরা পড়া থেকে বেঁচে যান। তবে মৃত্যুবরণ করেন সাথী মৌলভি সৈয়দ। পালিয়ে গিয়ে ভারতে প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দেন। লক্ষ্য সামরিক জান্তা, খুনি মোশতাককে সামরিকভাবেই পরাস্ত করা। কিছুদিন পরেই দলের নির্দেশে আবার সক্রিয় হন প্রকাশ্য রাজনীতিতে।

দেশে এসেই সামরিক বাহিনীর হাতে নির্যাতন আর একের পর এক কারাভোগের শিকার হন। তখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়। দলের নির্দেশে চলে বৈপ্লবিক প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ। মাঝে আওয়ামী লীগের ভেতরেই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে ওঠে। অদম্য সাহসী মহিউদ্দিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্য নিবেদিত হন। সব বাধা অতিক্রম করে শেখ হাসিনাকে দলের কাণ্ডারির দায়িত্ব নিতে সহায়তা করেন। তারপর এলো স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা এরশাদ। তারই শাসনামলে চট্টগ্রামে স্বয়ং এরশাদকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে চক্ষুশূল হন সরকারের। ফলে আবারও রাজনৈতিক বন্দি হন। ততদিনে চট্টগ্রামের আপামর জনতার নয়নমণি হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

পরবর্তীতে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির অন্যতম সুপুরুষ বলে বিবেচিত হন সর্বমহলে।

ছাত্রজীবনেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য; মুক্তিযুদ্ধের পর জড়িয়ে পড়েন শ্রমিক লীগের রাজনীতিতে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মহিউদ্দিন চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের শীর্ষ পদে ছিলেন। চট্টগ্রামে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বন্দর রক্ষা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।

তিনি ১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালের মেয়র নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন মন্ত্রীকে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মতো চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। ৭৪ বছরের জীবনে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের মেয়র ছিলেন ১৬ বছর। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.