Sylhet Today 24 PRINT

আওয়ামী লীগের সম্মেলন: বাদ পড়তে পারেন অর্ধেক নেতা

সিলেটটুডে ডেস্ক |  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

আসন্ন ২১তম জাতীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বড় ধরনের রদবদলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ২০০৯ সালের পর এবারই পরিবর্তনের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। গুঞ্জন রয়েছে, কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়তে পারেন প্রায় অর্ধেক নেতা। অনেক নতুন মুখ দেখা যাবে এবারের কমিটিতে। অন্যদিকে কপাল পুড়তে পারে প্রভাবশালীদের।

দলের বিগত দুটি সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে তেমন কেউ বাদ পড়েননি বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। দলের সম্পাদকমণ্ডলীতে অনেকেই আছেন, যারা দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন ধরে। এ দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক সফলতা ও ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশে এবারের সম্মেলনে পদোন্নতি বা পদচ্যুতি হতে পারে তাদের।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বর্তমান কমিটির যারা নিজ নিজ পদে কয়েক মেয়াদ ধরে বহাল রয়েছেন, তাদের কর্মকাণ্ডের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ চলছে। এদের মধ্যে যারা দায়িত্ব পালনে সফল হয়েছেন, তাদের পদোন্নতি দেয়া হবে আর ব্যর্থদের হবে পদচ্যুতি। এদের মধ্যে কাউকে করা হবে কার্যনির্বাহী সদস্য, আবার বয়স বিবেচনায় কেউ স্থান পেতে পারেন উপদেষ্টা পরিষদে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে তারা বলতে শুনেছেন, কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের মধ্যে কাজের লোক মাত্র ১৫ জন, যারা সবসময় রাজনীতিটাই করছে। দলীয় কাজে তাদের পাওয়া যায়। সে ধারণা থেকে বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকেই বাদ যেতে পারেন বলে মনে করছেন তারা। সে হিসাবে বর্তমান কমিটির ৪০-৫০ জন নেতার পদ হারানোর শঙ্কা রয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, দলের সম্মেলনে সবসময় প্রবীণ-নবীনের সমন্বয় ঘটানো হয়। এবারো তার ব্যতিক্রম হবে না। দলে অপেক্ষাকৃত প্রবীণ যারা, তাদের এবার উপদেষ্টা পরিষদে স্থান দেয়া হবে। তাদের স্থলে নিয়ে আসা হবে নবীনদের। ২০০৯ সালের মতো এবারো কার্যনির্বাহীর সদস্য থেকে বয়সে প্রবীণদের সভাপতিমণ্ডলীতে স্থান দেয়া হতে পারে।

নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ভবিষ্যৎ রূপরেখা হচ্ছে, বিতর্কিত ও অভিযুক্তরা আওয়ামী লীগে থাকতে পারবে না। গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দলে যারা ত্যাগী, আদর্শিক, সৎ ও দুঃসময়ের সঙ্গী, তারা কোণঠাসা হয়ে গেছেন। অন্যদিকে যারা টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস ও অবৈধ পন্থায় টাকা-পয়সা উপার্জন করেছেন, তাদের অনেকেই দলের নেতৃত্বে সামনের দিকে চলে এসেছেন। এ কারণে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তাদের বিষয়ে সব ধরনের খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। ভাবা হচ্ছে, অভিযুক্তদের দল থেকে ছেঁটে ফেলে ত্যাগী, পোড় খাওয়া ও সাবেক ছাত্রনেতাদের স্থান করে দেয়ার কথা।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের ১৮তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় একই বছরের ২৪ জুলাই। সে সম্মেলনে দল থেকে বাদ পড়েন এক-এগারোর সময়কার সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতারা। তাদের স্থলে জায়গা করে নেন অনেক সাবেক ছাত্রনেতা। এর পরের দুটি সম্মেলনে বড় কোনো চমক ছিল না। শুধু ২০তম সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের স্থলে নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের। ওই সময়ে সম্পাদক পদের সাতজন এবং কার্যনির্বাহী সদস্য পদের ১০ নেতা কমিটি থেকে বাদ পড়েন। এছাড়া কমিটির আকার ৭৩ থেকে বাড়িয়ে ৮১ করায় যুক্ত হন কয়েকজন নতুন মুখ।

এর মধ্যে ২০০৯ সালের সম্মেলনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ওই সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়েছিলেন ২৫ জন নেতা। এদের মধ্যে কয়েকজনেরই ছিল সংস্কারপন্থীর তকমা। সে সময় কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী অনেক সদস্যই বাদ পড়ে যান। সভাপতিমণ্ডলী থেকে বাদ পড়েন আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত এ পাঁচজনের জায়গা হয় উপদেষ্টা পরিষদে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় দলের পদ ছেড়ে দেন সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য জিল্লুর রহমান। এছাড়াও তত্কালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুকুল বোস, সাংগঠনিক সম্পাদক সাবের হোসেন চৌধুরী, আবদুল মান্নান, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ এবং কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন কমিটি থেকে বাদ পড়েন।

২০১২ সালে অনুষ্ঠিত সম্মেলন ছিল অনেকটাই নিয়ম রক্ষার। সে সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বহাল থাকেন। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে বাদ পড়েন ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। তাদের স্থান হয় উপদেষ্টামণ্ডলীতে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে বিতর্ক ওঠায় সম্পাদকমণ্ডলী থেকে শুধু তত্কালীন আন্তর্জাতিক সম্পাদক সৈয়দ আবুল হোসেন বাদ পড়েন। তার স্থলে জায়গা করে নেন জাতীয় সংসদের বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। কার্যনির্বাহী সদস্যের পদ থেকে বাদ পড়েন ছয়জন। ওই সম্মেলনে বন ও পরিবেশ সম্পাদকের পদটি খালি রাখা হয়।

এরপর অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন আনা হয়। এছাড়া গঠনতন্ত্র সংশোধন করে কার্যনির্বাহী কমিটির আকার ৭৩ থেকে বাড়িয়ে ৮১ করা হয়। এর মধ্যে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ১৩ থেকে বাড়িয়ে ১৭, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তিন থেকে চার, সাংগঠনিক সম্পাদক সাত থেকে আট এবং কার্যনির্বাহী সদস্য ২৬ থেকে বাড়িয়ে ২৮ করা হয়। ২০তম সম্মেলনে সভাপতিমণ্ডলী থেকে সতীশ চন্দ্র রায় এবং নূহ উল আলম লেনিনকে বাদ দেয়া হয়। সম্পাদকমণ্ডলীর ৩৪ জনের মধ্যে বাদ পড়েন ছয়জন। পদোন্নতি হয় সাতজনের। সম্পাদকমণ্ডলী থেকে বাদ পড়েন আ হ ম মুস্তফা কামাল, স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম, দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, আসাদুজ্জামান নূর, ডা. বদিউজ্জামান ডাবলু ও বীর বাহাদুর। এর মধ্যে সভাপতিমণ্ডলীতে স্থান পান নুরুল ইসলাম নাহিদ, আবদুর রাজ্জাক, ফারুক খান, আব্দুল মান্নান খান ও আব্দুল মতিন খসরু। উপদপ্তর সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাসকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক এবং উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক অসীম কুমার উকিলকে করা হয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক। ২৬ কার্যনির্বাহী সদস্যের পদ থেকে বাদ পড়েন ১০ জন। পদোন্নতি হয় চারজনের। তারা হলেন বর্তমান কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ও উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।

আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে বেগম সাজেদা চৌধুরী কমিটিতে টানা একই দায়িত্বে রয়েছেন। এর আগে তিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে। এছাড়াও টানা চার মেয়াদে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের দায়িত্ব পালন করছেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী ও কাজী জাফর উল্লাহ। টানা তিন মেয়াদে সাহারা খাতুন এবং দুই মেয়াদে মোহাম্মদ নাসিম ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন দায়িত্ব পালন করছেন।

সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ৩৪ সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যের মধ্যে ১৪ জনই গত তিন মেয়াদে টানা দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে শ্রমবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ চার মেয়াদে দায়িত্বে রয়েছেন। চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে তিনজন এবং আট সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে ছয়জনই গত তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাই এবার এ পদগুলোয় পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে তিনজনের পদোন্নতি ও একজনের পদাবনতি হতে পারে। আট সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে নতুন দুজন হয়তো দায়িত্বে বহাল থাকবেন। বাকি ছয়জনের মধ্যে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ও খালিদ মাহমুদ চৌধুরী পদোন্নতি পেতে পারেন। প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ পদোন্নতি পেতে পারেন। এছাড়া বর্তমান সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বা নতুন মুখ থেকেও সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আসতে পারেন।

সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যে প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ, আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আব্দুস সবুর, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, কৃষি ও সমবায় সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, শিক্ষা ও মানবসম্পদ সম্পাদক শামসুন নাহার চাঁপা, সংস্কৃতি সম্পাদক অসীম কুমার উকিল নিজ নিজ বিভাগভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের তত্ত্বাবধানেও পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনার হয়েছে।

কার্যনির্বাহী সদস্যদের মধ্যে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কামরুল ইসলাম, আজমত উল্লাহ খান, বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, এসএম কামাল হোসেন, রিয়াজুল কবির কাওছার, মেরিনা জাহান ও মারুফা আক্তার পপির পদোন্নতি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, আওয়ামী লীগের বিগত ২০টি সম্মেলন যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে প্রতিটি সম্মেলনে দেখা যাবে; নবীন ও প্রবীণের সমন্বয়ে নতুন মানুষ এসেছে। তাই এবারের সম্মেলনেও এর ব্যত্যয় ঘটবে বলে আমি মনে করি না।

তিনি বলেন, বর্তমান কমিটির মধ্যে কেউ যদি গত তিন বছরে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন বা অনিয়মে অভিযুক্ত হন, তাহলে তাদের বাদ দিয়ে সেখানে নবীনদের আনা হবে। এটাই আমাদের সবসময়ের নিয়ম এবং আগামীতেও তাই হবে বলে আমি মনে করি।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.