Sylhet Today 24 PRINT

‘খেটে খাওয়া মানুষ ভিক্ষা করতেও জানি না’

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ১৯ মে, ২০২০

মহাবীর কল। একজন অবসরপ্রাপ্ত চা শ্রমিক। একদিন চা বাগানের বাবুর{স্টাফ} ভুলে মারাত্মকভাবে আঘাত পান হাতে এবং হাতটি কেটে ফেলতে হয়। পরে উনাকে অবসরে যেতে বাধ্য করা হয়। চিকিৎসা করাতে চা বাগানের মালিক কিছু দিয়েছিলেন। সে সময় নিজের যা ছিল সেগুলোও শেষ। তিনি বলেন, পরে আমি মেয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। আমার মেয়ের তিন সন্তান। সেই সময় মেয়ের স্বামীও মারা যায়। এর ভিতর চা বাগান বন্ধ হওয়ায় আমার মেয়ে একটিমাত্র কাজও বন্ধ হয়ে যায়। এখন আমরা বেশীরভাগ সময় না খেয়ে দিনাতিপাত করছি।

''অন্যদিকে রইজ হামরা রাস্তায় বইসে ভিখ মাঙার মতো ভাইলতে থাকি কেউ চাইল ডাইল লিয়ে আইসবেক ন নাই। আইলো তো ভালো। ঐদিন খাইতে পারি। আর নাইলে উপাসেই থাকি। হামরাতো একবেলা খাই আর দুবেলা উপাসে কাটা'', বলছিলেন চা শ্রমিক বিধবা সুরেখা তাতি।

তাদের মতো ৩৮৫ স্থায়ী চা-শ্রমিকসহ তাদের পরিবার করোনার দিনে অনাহারে দিনাতিপাত করছেন। গত ৬ মার্চ থেকে রেমা চা-বাগান বন্ধ। আজ প্রায় দুইমাসের উপরে এই বাগানের চা-শ্রমিকের কাজ নেই, মজুরি নেই, খাবার নেই, চিকিৎসা নেই। তারা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।

বাগানের চা-শ্রমিক দিপালী বাড়াইক বলেন, ‘আমরা চিকিৎসা পাচ্ছি না। মালিক আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ ভিক্ষা করতেও জানি না।’

তিনি বললেন, ‘এই চা বাগানে করোনাভাইরাস আসার আগেই না খেয়ে মরতে হবে। মাস্কের দরকার নেই। আমার পরিবারের জন্য এখন খাবার অত্যন্ত জরুরি। আমরা মাড়ভাত ও পাতিসানা{চা পাতার ভর্তা খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। একদিকে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক, অন্যদিকে বাড়িতে খাবার নাই। চা বাগানের বাইরে কাজেও যেতে পারছি না।’

চা-শ্রমিক নেতা অরুণ দাস পাইনকা বললেন, আমাদের বকেয়া, বোনাস ও বকেয়া মজুরি এখনো পাইনি।

তিনি আরও জানান, গত ২ মার্চ চা-শ্রমিকদের খেলার মাঠ দখল করে বাগান ব্যবস্থাপক চারা রোপণ করার হাল চাষ চেষ্টা করলে চা-শ্রমিকদের সঙ্গে বিরোধ হয়। ৩ মার্চ চা বাগান কর্তৃপক্ষ এসে আবার চাষ দেয়। ৪ ও ৫ মার্চ চা শ্রমিকরা এর প্রতিবাদে এক ঘন্টা কর্মবিরতি পালন করে। ৫ মার্চ সকালে চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এসে সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু বিরোধের জের ধরে বাগান ব্যবস্থাপক চুনারুঘাট থানায় অভিযোগ করলে ৫ মার্চ বিকেলে পুলিশ তদন্ত করতে বাগানে আসে। এতে ক্ষেপে যায় শ্রমিকরা। এরপর ৬ মার্চ বাগান ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য নির্মল দেব বলেন, ‘এ ঘটনায় বাগানের সাবেক পঞ্চায়েত মানিক দাস ও আমাকেসহ ২৫ জনকে আসামি করে বাগান কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের করেছেন। একই সঙ্গে বাগান বন্ধ করে দিয়ে তারা তালা দিয়ে চলে গেছেন।’

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ফেডারেশনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আবুল হাসান বলেন, ‘আড়াই মাস ধরে বাগানের চা-শ্রমিকদের কাজ নেই, হাজিরা নেই, রেশন নেই। দেশের জাতীয় দুর্যোগ করোনার সময়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে চা-শ্রমিকরা আন্দোলন, মিছিল, সমাবেশ করতে পারছে না।’

চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, আজ পর্যন্ত রেমা বাগান খোলা হয়নি এবং খুব শীঘ্রই খোলার কোন সম্ভাবনাও তারা দেখতে পারছে না। তাহলে কি রেমা চা বাগানের চা-শ্রমিক অনাহারে দিন কাটাবে?’

শ্রমিকদের অভিযোগ, সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন হবিগঞ্জ জেলা সমন্বয়কারী তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘বাগানের বয়স্ক শ্রমিকদের অনেকে ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তা নিয়ে বাগান কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থাই নিচ্ছে না।

তিনি বলেন, রেমা বাগানের সব চা-শ্রমিককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এখন খাবার দরকার। বাগানের শ্রমিকদের সামর্থ্য নেই খাবার যোগার করার।’

করোনার সময়কে মাথায় রেখেই সারা দেশের প্রগতিশীল সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদেরকে রেমা চা-বাগানের শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন তিনি।

চা-বাগানের ম্যানেজার দিলিপ সরকারকে ১০-১৫ বার ফোন দিলে রিং হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

চা বাগানের সুপারভাইজার মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল জলিল বলেন, চা বাগানে একটি মাঠ আছেই। শ্রমিকরা আরেকটি মাঠ দাবি করে। অন্যদিকে চা বাগান কর্তৃপক্ষ অন্য মাঠে চা গাছের নার্সারি লাগাতে চাই। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আমরা কয়েকজন আহত হই।

তিনি বলেন, গত রোববার চা শ্রমিকরা তিনটি দাবি করছে। এর ভিতর কাজে না যাওয়া আড়াই মাসের মজুরি যা সম্পূর্ণ অনৈতিক। শ্রমিকরা কোনও ঘোষণা ছাড়াই কাজ বন্ধ রেখেছে। তারা কাজে আসলেই আমরা বাগান চালু করবো বলে মালিকের নির্দেশনা রয়েছে।’

‘চা-শ্রমিকরা বলছেন আপনারা বন্ধ করেছেন’ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।’

হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। একটু সময় লাগছে।’

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.