Sylhet Today 24 PRINT

ভর্তি করেনি ৬ টি হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গেলেন নারী

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ০২ জুন, ২০২০

শ্বাসকষ্ট নিয়ে ছয়টি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি হতে না পেরে সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার আগে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গেছেন ৬৩ বছর বয়সী এক নারী।

সিলেট নগরীর কাজিরবাজার মোগলটুলা এলাকার বাসিন্দা ওই নারী দীর্ঘদিন ধরে অ্যাজমায় ভুগছিলেন। গত রবিবার রাতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান বলে জানিয়েছেন তার পরিবার ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি।

নিজের ও মৃত নারীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, ‘ওই নারীর অসুস্থতার খবর পেয়ে আমি দ্রুত তাদের বাসায় যাই। রাত সোয়া ১২টার দিকে তাকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে আল হারামাইন হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু তারা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তাকে ভর্তি করেনি।’

তিনি বলেন, ‘তারপর পর্যায়ক্রমে ওয়েসিস হাসপাতাল, নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট মা ও শিশু হাসপাতাল, পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। রাত সোয়া দুইটার দিকে তাকে নিয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছালে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান যে তিনি অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গিয়েছেন।’

এতগুলো হাসপাতালের মধ্যে মা ও শিশু হাসপাতাল একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে সহযোগিতা করেছে এবং রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা দ্রুত এক্স-রে করিয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেও সবাই বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে রোগী ভর্তি করেনি বলেও জানান তিনি।

বিজ্ঞাপন



তিনি জানান, মৃত নারীর জানাজা শেষে সোমবার দুপুরে তাদের গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার কাসাদিঘীরপার গ্রামে দাফন সম্পন্ন করা হয়।

তিনি বলেন, ‘পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই প্রবাসী। তারা চেয়েছিলেন তাদের মায়ের ভালো হাসপাতালে চিকিৎসা হোক। কিন্তু সিলেটের এ সব নামী হাসপাতাল তাকে ভর্তি করেনি। মায়ের মৃত্যুতে কষ্ট পেলেও ঝামেলা এড়াতে কোনো অভিযোগ দায়ের করছেন না তারা।’

যা বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ

আল হারামাইন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. নাহিয়ান চৌধুরী বলেন, ‘দুই বছর আগে শুরু হলেও এখনো হাসপাতালের পূর্ণ কার্যক্রম শুরু হয়নি এবং মাত্র ৮০টি বেড নিয়ে আমরা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি। সে রাতে আমাদের সব বেডে রোগী ছিলেন এবং আইসিইউ ও সিসিইউতেও কোনো বেড খালি না থাকায় আমরা তাকে ভর্তি করতে পারিনি। ইচ্ছাকৃতভাবে না, বরং বাধ্য হয়েই সে রাতে ওই নারীসহ পাঁচ জন রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে।’

ওয়েসিস হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। হাসপাতালের সহকারী ব্যবস্থাপক মনসুর আলম বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর উপসর্গ থাকা রোগীদের জন্য আমাদের হাসপাতালে তিন বেডের ফ্লু কর্নার আছে। সে রাতে কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যদি কেউ এরকম অভিযোগ করেন, তবে তা মিথ্যা।’

নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। এ কারণে হাসপাতালের সব সাধারণ রোগীকে একটি ভবনে স্থানান্তর করা হচ্ছে এবং অন্য ভবনটিকে কোভিড-১৯ এর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এরকম সময়ে একজন কোভিড সাসপেক্টেড রোগী আসায় তাকে ভর্তি করা যায়নি, তবে আমরা আজ মঙ্গলবার থেকে সব ধরণের রোগী ভর্তি করবো।’

সিলেট মা ও শিশু হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মুর্শেদুর রহমান বলেন, ‘ওই নারীর যে অসুস্থতা ছিল, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা আমাদের কাছে না থাকায় আমরা তাকে ভর্তি করতে পারিনি। তবে তার অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন শেষ হয়ে যাচ্ছিল, তাই আমরা একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে সহযোগিতা করেছি।’

পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. তন্ময় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ওই রোগী যখন আমাদের কাছে আসেন, তখন আমাদের হাসপাতালের দুটি ভেন্টিলেটরই অন্য রোগীদের জন্য ব্যবহার হচ্ছিল। সেসময় উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৬০ ভাগের নিচে নেমে আসে এবং আইসিইউতে বেড থাকলেও ভেন্টিলেটর ছাড়া এ অবস্থায় চিকিৎসা সম্ভব না ভেবে আমরা রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজে যেতে পরামর্শ দেই।’

জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. তারেক আজাদ বলেন, ‘ওই রোগী এখানে আসার পর আমাদের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ও আইসিইউতে কর্তব্যরত চিকিৎসক উনাকে দেখেন। পরে আইসিইউ কনসালটেন্টের পরামর্শে উনার এক্সরেও করা হয়। এক্সরের রিপোর্ট দেখে কোভিড-১৯ সন্দেহভাজন রোগী মনে হওয়ায় এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ থাকায় তাদেরকে কোভিড চিকিৎসায় বিশেষায়িত সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য বলা হয়।’

তিনি বলেন, ‘যা হয়েছে, তা খুবই দুঃখজনক। এ ধরণের পরিস্থিতিতে আমাদের সবাইকে আরও সতর্ক হতে হবে। তাই আমরা ইতোমধ্যে আমাদের চিকিৎসকদের নির্দেশনা দিয়েছি, যদি সন্দেহভাজন রোগীও হয়, তবে যেনো ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করেন। পরে পরীক্ষায় কোভিড পজিটিভ আসলে এবং বিশেষায়িত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো যেতে পারে।’

যা বলছে স্বাস্থ্য বিভাগ

বিজ্ঞাপন



গত ২৪ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে জারিকৃত একটি নির্দেশনায় বলা হয়, সকল সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ৫০ বা তার বেশি শয্যাবিশিষ্ট, তারা বাধ্যতামূলকভাবে কোভিড-১৯ সন্দেহভাজন ও সাধারণ রোগীদের জন্য পৃথক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করবেন।

সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ঘোষিত এ নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা সিভিল সার্জন একবার এবং বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয় থেকে একবার সব হাসপাতালকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তারপরও রোগী ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেওয়া খুবই দুঃখজনক।’

তিনি বলেন, ‘ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তারা যদি আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কাছে অভিযোগ দিতেন, তাহলে আমরা শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতাম। তবে আমরা বিষয়টি উল্লেখ করে সব হাসপাতালকে সতর্ক করে চিঠি পাঠাচ্ছি যাতে এরকম ঘটনা আর না ঘটে।’

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, ‘কোনো রোগী কোথায় ভর্তি হবেন, এটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে আমাদের হাসপাতাল সর্বোচ্চ চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে সবসময়ই খোলা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতাল সারাবছর ব্যবসা করবে, আর এখন জরুরি অবস্থার সময় তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, তা উচিত না। এই মৃত্যুর দায় এখন কে নেবে? সরকারি নির্দেশনা আছে সব রোগীকেই সেবা দিতে হবে। এ নির্দেশনা অবশ্যই সবাইকে মানতে হবে।’

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.