Sylhet Today 24 PRINT

সাইকেল চুরির অভিযোগে কিশোরকে বেঁধে নির্যাতন!

ফেসবুকে ছবি ভাইরাল

এস আলম সুমন, কুলাউড়া |  ০৪ জুন, ২০২০

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মুস্তাফিজ সুয়েজ (১৬) নামে এক কিশোরকে বেঁধে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠেছে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে। নির্যাতিত ওই কিশোরের একটি ছবি মঙ্গলবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

দুই যুবকের নারীঘটিত ও টাকা পয়সা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে কিশোর মুস্তাফিজকে পেটানো হয় বলে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে। তবে পেটানোর সময় মুস্তাফিজের বিরুদ্ধে বাইসাইকেল চুরির অভিযোগ আনা হয়।

নির্যাতিন মুস্তাফিজ উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের চান্দপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল জলিলের ছেলে। স্থানীয় ইউপি সদস্য বাদশা মিয়ার নেতৃত্বে তাকে পেটানো হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এদিকে ঘটনার ১৮ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো বিচার পায়নি কিশোর মুস্তাফিজের পরিবারের।

বিজ্ঞাপন



জানা যায়, গত ২ মে টিলাগাঁওয়ের আশ্রয় গ্রামের বাসিন্দা হোটেল ব্যবসায়ী কাইয়ূম মিয়ার ব্যবহৃত বাইসাইকেলটি মনু নদীর আশ্রয়গ্রাম বাঁধ এলাকা থেকে হারিয়ে যায়। এর ১২ দিন পর ১৪ মে কাইয়ূমের হারিয়ে যাওয়া বাইসাইকেলটি পার্শ্ববর্তী পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ছৈদলবাজারে শাহ আলমের নিকট পাওয়া যায়। খবর পেয়ে ওই রাতে টিলাগাঁও ইউনিয়নের ৬নং ওয়াডের্র সদস্য মো. বাদশা মিয়া ও ১ নং ওয়ার্ডের সদস্য মখলিছুর রহমান, সাইকেলের মালিক কাইয়ূম, গ্রাম পুলিশ শাহাব উদ্দিন ও ফরিদকে নিয়ে ছৈদলবাজার এলাকায় গিয়ে সাইকেলটি উদ্ধার করেন এবং এসময় সেখানে আটকে রাখা কিশোর মুস্তাফিজকে হাত বেঁধে টিলাগাঁওয়ের আশ্রয়গ্রামে নিয়ে আসেন। এসময় তারা মুস্তাফিজকে একটি দোকানের বেড়ার সাথে বেঁধে রেখে মারধর করেন। এদিকে রাতে ছেলের কোন খবর না পেয়ে মুস্তাফিজের পিতা আব্দুল জলিল ও চাচা আব্দুল মান্নান বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুজি করতে থাকেন। সকালে খবর পান মুস্তাফিজকে আশ্রয়গ্রামে চুরির অভিযোগে বেঁধে রাখা হয়েছে।

এরপর আব্দুল জলিল বিষয়টি স্থানীয়দের অবগত করেন এবং তাদের সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। সেখানে গিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ইউপি সদস্য বাদশা মিয়াকে অনুরোধ করেন। তখন বাদশা মিয়া তাদের জানান, মুস্তাফিজকে ছাড়িয়ে নিতে হলে ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালিককে জানাতে হবে। তিনি নির্দেশ দিলে মুস্তাফিজকে ছেড়ে দেওয়া হবে। পরে আব্দুল জলিলসহ স্থানীয় মুরব্বী তছবির আলীকে নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালিকের বাড়িতে গিয়ে ঘটনাটি অবগত করেন। চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক বিষয়টি পরবর্তীতে সালিশে নিষ্পত্তির আশ্বাস দিয়ে তছবির আলীর জিম্মায় মুস্তাফিজকে তার অভিভাবকের নিকট হস্তান্তর করেন। ৩ জুন এই বিষয়ে সালিশি বৈঠক হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এর আগের দিন মঙ্গলবার ২ জুন মুস্তাফিজকে হাত বেঁধে রাখার একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ব্যপক প্রতিক্রিয়া তৈরী হলে চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক পূর্বনির্ধারিত সালিশী বৈঠক স্থগিত করেন।

বুধবার বিকেলে সরেজমিনে মুস্তাফিজের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, মুস্তাফিজ স্থানীয় আশ্রয় গ্রামের বাসিন্দা মৃত হুরমত আলীর ছেলে মো. শামীম ওরফে কুদরতের সাথে মনু বাঁধ এলাকায় বালু উত্তোলনের শ্যালো মেশিন পাহারা ও সেখানে দৈনিক মজুরীতে কাজ করতো। সেই সুবাদে গত ২ মে ব্যবসায়ী কাইয়ুমের সাথে কুদরতের টাকা পয়সার লেনদেন ও নারীঘটিত পূর্ব বিরোধের জেরে কাইয়ুমের বাইসাইকেলটি পাশ্ববর্তী পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ছৈদল বাজারে শাহ আলমের নিকট পাঠাতে কিশোর মুস্তাফিজকে বলে কুদরত। তার কথামতো কিশোর মুস্তাফিজ সাইকেলটি শাহ আলমের নিকট পৌঁছে দেয়। এরপর ওই সাইকেলটি চুরি হয়েছে বলে অভিযোগ এনে মুস্তাফিজকে বেঁধে মারধর করা হয়। এখনো মুস্তাফিজের শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

বিজ্ঞাপন



মুস্তাফিজের বাবা ও চাচা্ বলেন, চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য আমাদের বিষয়টি বৈঠকের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে দিবেন বলে আশ্বাস প্রদান করলে আমরা প্রশাসনকে বিষয়টি জানাইনি। তাদের দেওয়া পূর্বনির্ধারিত বৈঠকের তারিখ ৩ জুন ছিলো। কিন্তু আগের দিন চেয়ারম্যান আমাদের ফোন করে বলেন বিচার এখন স্থগিত করা হয়েছে।

মুস্তাফিজের বাবা আব্দুল জলিল বলেন, কাইয়ূম ও কুদরতে বিরোধের কারণে আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে চুরির অপবাদ দিয়ে নির্যাতন করা হলো। এতে আমার পরিবারের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে। এঘটনার ন্যায় বিচার চাই প্রশাসনের কাছে।

এ বিষয়ে শামীম ওরফে কুদরত জানায়, ‘কাইয়ুমের হোটেলে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করার সুবাদে সে অনেকসময় অতিরিক্ত টাকা আমার কাছ থেকে রাখতো। পরবর্তীতে সেই অতিরিক্ত টাকা ফেরত চাইলে কাইয়ূম আমাকে তাঁর বাই সাইকেলটি দিয়ে দেয়। সেটি বিক্রির জন্য মুস্তাফিজকে দিয়ে ছৈদল বাজারে শাহ আলমের কাছে পাঠাই এবং পরে একদিন আবার সেই টাকা আনার জন্য মুস্তাফিজকে সেখানে পাঠাই।’

কুদরত জানায়, ‘কাইয়ূম আমাকে আমার পরিচিত এক নারীর সাথে অবৈধ কাজ করার জন্য বলতো। আমি না করায় ওই নারীর মোবাইল নাম্বার দিতে বলতো। এজন্য কাইয়ূম পরিকল্পিতভাবে আমাকে সাইকেল দিয়ে পরে সেটি চুরির অভিযোগ তুলে। এরপর মুস্তাফিজ ওই এলাকায় গেলে তাকে সেখানে আটকে রেখে মারধর করা হয়। আসলে সাইকেল চুরির কোন ঘটনা ঘটেনি। মুস্তাফিজকে কেন মারধর করা হল সেটা আমি অবগত নই। মেম্বারের ভয়ে আমি তখন এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দেই।’

এ বিষয়ে ব্যবসায়ী কাইয়ুম জানান, ‘আমার ব্যক্তিগত পুরাতন বাই সাইকেলটি টিলাগাঁওয়ের চড়ক বাঁধ এলাকায় রেখে আমার বোনের বাড়িতে যাই। সেখান থেকে ফিরে সাইকেলটি পাইনি। বিষয়টি মেম্বার বাদশা মিয়াকে জানাই। পরে জানতে পারি সাইকেলটি ছৈদলবাজারে আছে এবং সেখানকার লোকজন মুস্তাফিজকে আটকে রেখে খবর দিলে মেম্বারসহ আমরা সেখানে যাই। এসময় তাকে হাতে বেঁধে আশ্রয়গ্রামে আনা হয়। এসময় মুস্তাফিজকে কি করেছেন সেটা মেম্বারই ভালো বলতে পারবেন।’

অভিযুক্ত ইউপি সদস্য বাদশা মিয়া জানান, ‘আমার ওয়ার্ডের ব্যবসায়ী কাইয়ুমের চুরি যাওয়া সাইকেলটি পৃথিমপাশার ছৈদল বাজারে পাওয়া গেছে বলে জানতে পেরে সেখানে গ্রাম পুলিশসহ যাই। কিশোর মুস্তাফিজের উশৃঙ্খল আচরণ ও যাতে পালিয়ে না যায় সেজন্য তাকে সেখান থেকে হাত বেঁধে আশ্রয়গ্রামে একটি দোকানে এনে রাখা হয় তবে কোন মারধরের ঘটনা ঘটেনি। বিষয়টি সালিশি বৈঠকে নিষ্পত্তির জন্য চেয়ারম্যানকে জানালে তিনি তারিখ নির্ধারণ করে দেন।

এ বিষয়ে টিলাগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক জানান, চুরি যাওয়া সাইকেলটি গত ১৪ মে পৃথিমপাশার ছৈদলবাজার থেকে উদ্ধার করা হয় এবং এসময় এ ঘটনায় জড়িত আটক মুস্তাফিজকেও সেখান থেকে হাত বেঁধে আশ্রয়গ্রামে নিয়ে আসেন ইউপি সদস্য বাদশা মিয়া। মুস্তাফিজের অভিভাবক তাকে ছেড়ে দেওয়ার ও বিষয়টি নিষ্পত্তির অনুরোধ করেন। মুস্তাফিজকে ছেড়ে দেয়া জন্য বাদশা মিয়াকে বললে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে ৩ জুন বিষয়টি সালিশী বৈঠকে নিষ্পত্তি করার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এর আগের দিন বিষয়টি বানচালের উদ্দেশ্যে একটি গোষ্ঠি ফেসবুকে ছবিটি ভাইরাল করেছে।

তিনি বলেন, প্রশাসন বিষয়টি আমার কাছে জানতে চাইলে আমি প্রশাসনকে ঘটনাটি তদন্ত করে দেখার জন্য বলি।

কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ইয়ারদৌস হাসান বলেন, ‘বাইসাইকেল চুরির ঘটনায় এক কিশোরকে স্থানীয়রা আটক করেছে শুনেছিলাম। এ বিষয়টি খোঁজখবর নিচ্ছি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী এ ব্যাপারে বলেন, 'ঘটনাটি শুনেছি। এখনো কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। কিশোরে পরিবার সহযোগিতা চাইলে সবধরণের আইনী সহযোগিতা করা হবে।’

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.