Sylhet Today 24 PRINT

সিলেটে হঠাৎ বেড়ে গেছে সীমান্ত হত্যা

গত একমাসে সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে ভারতীয়দের গুলিতে অন্তত ৫ বাংলাদেশির মৃত্যু, আহত অন্তত ১০

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ১৬ জুলাই, ২০২০

সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধে সম্প্রতি গোয়াইনঘাটের সীমান্তবর্তী এলাকায় জনসচেতনতামূলক সভা করে বিজিবি। ফাইল ছবি

সীমান্তবর্তী অঞ্চল সিলেট। ভারতের সাথে সিলেটের রয়েছে বিস্তৃর্ণ সীমান্ত। রয়েছে সীমান্ত দিয়ে যাতায়াত ও আমদানি-রফতানি। তবে করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ রয়েছে এসব কার্যক্রম। তবে এই সময়ে সিলেট এলাকায় বেড়ে গেছে সীমান্ত হত্যা।

গত একমাসে সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে ভারতীয়দের গুলিতে অন্তত ৫ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১০ জন। হতাহতদের প্রত্যেকেই অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

কেনো হঠাৎ করেই সিলেটের সীমান্তগুলো দিয়ে বেড়ে গেছে অবৈধ অনুপ্রবেশ। সীমান্তও হত্যাও হঠাৎ বেড়ে গেলো্ কেনো।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, করোনার প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েছে সীমান্ত এলাকার মানুষ। বন্ধ রয়েছে সীমান্ত দিয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। সীমান্ত হাটগুলোও বন্ধ। একারণে গত তিন মাসে সিলেটের সীমান্ত এলাকা দিয়ে বেড়ে গেছে অবৈধ অনুপ্রবেশ। সুপারী-আনারস প্রভৃতি চুরির উদ্দেশ্যে সীমান্তবর্তী দরিদ্র কিছু লোক অবৈধভাবে ভারতে ঢুকে পড়ছে। আর ভারতের সীমান্তবর্তী খাসিয়া বাসিন্দারা করোনা সংক্রমনের ভয়ে নিজেদের এলাকায় এখন কাউকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। ফলে কেউ লুকিয়ে প্রবেশ করলেই গুলি ছুঁড়ছে তারা। এতে বেড়েছে সীমান্ত হত্যা।

বিজ্ঞাপন



করোনাকালীন সময়ে সীমান্ত দিয়ে চোরাচালানও বেড়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। যদিও প্রশাসন ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

কোম্পাপনীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদের মতে, সীমান্ত হাটগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া ও আদমানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বিভিন্ন পণ্য আনতে অনেকেই অবৈধভাবে ভারত চলে যাচ্ছে। গত ৩/৪ মাস ধরে এমন প্রবণতা বেড়েছে বলে জানান তিনি।

শামীম আহমদ বলেন, করোনা সংক্রমণের ভয়ে ভারতীয় খাসিয়ারা আদিবাসীরা নিজেদের গ্রামে অন্য কাউকে ঢুকতে দেয় না। তাই লুকিয়ে কেউ ঢুকে পড়লেই তারা গুলি ছুঁড়ে।

সর্বশেষ গত ১১ জুলাই দুপুরে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের উৎমা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে ঢুকে পড়েন দুই বাংলাদেশি। তাদের দেখে গুলি ছুঁড়ে স্থানীয় খাসিয়া অধিবাসীরা। গুলিতে মারা যারা বাবুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। আহত হন আরেকজন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সুপারী চুরির উদ্দেশ্যে ভারতের খাসিয়া পুঞ্জিতে একসঙ্গীসহ গিয়েছিলেন বাবুল। চুরির সময় স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের গুলি করে।

এর আগে ২ জুলাই গোয়াইনঘাট সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়া বাসিন্দাদের গুলিতে সিরাজ উদ্দিন, ২৮ জুন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে জুয়েল মিয়া, ২০ জুন কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তে খাসিয়াদের গুলিতে বাবুল বিশ্বাস ও ১০ জুন গোয়াইনঘাট সীমান্তে খাসিয়াদের গুলিতে মিন্টু মিয়া মারা যান। এরআগে ২৩ মে গোয়াইনঘাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে কালা মিয়া নামের আরেক যুবক মারা যান।

বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, এরা প্রত্যেকেই অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সুপারিসহ বিভিন্ন সামগ্রী চুরির সময় তাদের গুলি করা হয়।

বিজিবি’র একাধিক কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, গত মে থেকে সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুরসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে সুপারি, আনারস, কাঁঠাল ইত্যাদি চুরির জন্য সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের মাত্রা বেড়েছে।

করোনায় কর্মহীনতার কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন বিজিবি’র কর্মকর্তারা। তাদের মতে, সীমান্তবর্তী এলাকার জনসাধারণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিকভাবে তাদেরকে স্বাবলম্বী করা না গেলে এই প্রবণতা ঠেকানো কঠিন হবে।

সংশ্লিস্ট সূত্রে জানা যায়, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সংগ্রাম পুঞ্জি, বিছনাকান্দি, মাতুরতল, জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল ও সুরাইঘাট, ডিবিরহাওর এবং কানাইঘাট, জকিগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে সবসময়ই চোরাচালান হয়। এসব সীমান্ত দিয়ে গরু, মাদক ও সিগারেট চোরাচালান চলে আসছে অনেকদিন থেকেই। এখন সুপারী-আনারসের মতো পণ্য চুরি করতেও অনেকে অবৈধভাবে চলে যাচ্ছে ভারতে।

বিজ্ঞাপন



এ প্রসঙ্গে বিজিবি’র ৪৮ ব্যাটেলিয়ানের অধিনায়ক লে. কর্ণেল আহমেদ ইউসুফ জামিল, পিএসসি বলেন, সীমান্ত এলাকার বেশিরভাগ মানুষই দরিদ্র। তারা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। করোনার কারণে অনেকেরই কাজ নেই। ওই এলাকাগুলোর কর্মসংস্থানের অন্যতম ক্ষেত্র পাথর ও বালু উত্তোলন। করোনা ও বন্যার কারণে এগুলো বন্ধ রয়েছে। সীমান্ত দিয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমও বন্ধ। ফলে স্থল বন্দরগুলোতে যারা কাজ করতো তারাও কর্মহীন হয়ে পড়েছে। একারণে অনেকেই চুরির উদ্দেশ্যে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে ভারতে ঢুকে পড়ছে।

তিনি বলেন, করোনার ঝুঁকি নিয়েই বিজিবি সদস্যরা সীমান্তে টহল দিচ্ছে। বন্যায় আমাদের অনেক চৌকি পানিতে তলিয়ে গেছে। তবু বিজিবি সদস্যরা সীমান্তে টহল দিয়ে যাচ্ছেন।

আহমেদ ইউসুফ জামিল বলেন,  সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক কর্মসংস্থান ও জনসচেতনতা তৈরি ছাড়া অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানো অনেকটাই অসম্ভব।

তবে চোরাচালান ও অবৈধ অনুপ্রবেশ বাড়েনি বলে দাবি করেছেন গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুস সাকিব। তিনি বলেন, অবৈধ অনুপ্রবেশ আগেও ছিলো। কিন্তু আগে এতো গুলি ও হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটতো না। কেউ অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করলে ভারতীয়রা তাদের আটকে রাখতো। হেনস্তা করতো। পরে ফিরিয়ে দিতো। কিন্তু এখন করোনার ভয়ে দেখলেই গুলি করছে। ফলে সীমান্ত হত্যা বেড়েছে।

তিনি বলেন, চোরাচালান বরং আগের তুলনায় কমেছে। কারণ ভারতে লকডাউনের কারণে চোরাকারবারিরা পণ্য আনতে পারছে না।

সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও সীমান্ত হত্যা বেড়ে যাওয়ায় এসব প্রতিরোধে গত মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) কোম্পানীগঞ্জের কালাসাদেক বিওপি সংলগ্ন এলাকায় জনসচেতনতামূলক সভা করে বিজিবি। এতে বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও সরাইল রিজিওনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাকির হোসেন অংশ নেন।

এরআগে ৪ জুলাই গোয়াইনঘাট সীমান্তে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবির যৌথ উদ্যোগে সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

সমাবেশে বক্তারা যেকোন মূল্যে সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মাদক, চোরাচালান, অনুপ্রবেশসহ অবৈধ সকল তৎপরতা বন্ধ করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।

সীমান্তে হত্যা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, সিলেটের সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতের প্রবেশ করে গাছ থেকে সুপারী, লাকড়ি, আনারস কিংবা পাথর আনতে গিয়ে অনেকেই হতাহত হচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা কিছুটা বেড়েছে। এজন্য জনগনকে সচেতন করতে পুলিশ নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.