Sylhet Today 24 PRINT

কমলগঞ্জে গ্রেপ্তার আতংকে ঘরে ঘরে ঝুলছে তালা

ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রশাসনের উপর হামলার ঘটনায় মামলা

কমলগঞ্জ প্রতিনিধি |  ২৫ নভেম্বর, ২০২০

কয়েকটি বসতবাড়ি উচ্ছেদ করে গাছ কেটে ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প কাজে প্রশাসনের উপর হামলার ঘটনা ঘটে। গত ১৬ নভেম্বর সোমবার দুপুরে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের রাজকান্দি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার দিন রাতেই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর দায়েরকৃত মামলায় নিরীহদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি গ্রেপ্তার আতঙ্কে কমলগঞ্জের রাজকান্দি এলাকার ঘরে ঘরে তালা ঝুলছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে অধিকাংশ পুরুষরা বাড়ি ছাড়া। দিনের বেলায় হাতেগোনা কয়েকজন পুরুষকে দেখা গেলেও রাতে সে সংখ্যা নেমে আসে শূন্যের কোটায়। কমলগঞ্জের এসিল্যান্ডের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার পর থেকে পুরুষ সদস্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। উৎকণ্ঠায় তাদের মানবেতর জীবন যাপন চলছে।

সরেজমিন রাজকান্দি গ্রাম ঘুরে জানা যায়, স¤প্রতি কমলগঞ্জের ইসলামপুর ইউনিয়নের রাজকান্দি এলাকার সরকারি খাসজমি বের করে ‘দুর্যোগ সহনীয় গৃহ নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় ‘আশ্রয়ণ-২’ প্রকল্পের ২০টি গৃহ নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করা হয়। ১৬ নভেম্বর প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর করার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সাইনবোর্ড স্থানীয়রা ভেঙে ফেলা হয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে হামলার শিকার হন কমলগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাসরিন চৌধুরী। এ সময় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় এসিল্যান্ড নাসরিন চৌধুরী, নারী পুলিশ সদস্য সেলিনা আক্তারসহ ৩ জন আহত হন। এ সময় এসিল্যান্ড এর ব্যবহৃত সরকারি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।

এ ঘটনার পর পরই কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ। এদিকে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার দিন রাতে কমলগঞ্জ থানায় মামলা করা হয়। সরকারি কাজে বাধা, হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে কমলগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাসরিন চৌধুরী বাদী হয়ে এ মামলা করেন। মামলায় নারী-পুরুষ ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে ৫৩-৫৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।

মামলার পর ওইদিন রাতে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৮ জন ও পরে আরও ২ জনসহ ১০ জনকে আটক করে পুলিশ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত নয় তাদেরকে হয়রানি করা হচ্ছে।

মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) বিকালে সরজমিনে দেখা যায়, মামলার প্রধান আসামি সুন্দর মিয়ার বাড়িসহ ঘটনাস্থলের আশপাশের বাড়িগুলোতে কোনো মানুষ নেই। প্রতিটি বসতঘরে ঝুলছে তালা। গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়ির পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোনো কোনো বাড়িতে পুরুষ থাকলেও হঠাৎ গাড়ির শব্দ পেলেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। গ্রেপ্তার আতঙ্কে নিরপরাধ অনেক মানুষও বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে স্থানীয়রা জানান।

ভূমিহীনদের জন্য সরকারের জনবান্ধব কর্মসূচী আশ্রয়ণ প্রকল্প কর্মসূচীর জন্য ইসলামপুর ইউনিয়নের রাজকান্দি গ্রাম এলাকায় সরকারি খাস জমিতে প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে প্রকল্প গ্রহণকৃত ঐ স্থানে বসতবাড়ি নির্মাণ, ফলজ-বনজ গাছ রোপণ, পানের বরজ রোপণ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন প্রায় শতাধিক পরিবার। কয়েকটি বাড়ি উচ্ছেদ করে গাছ, বাঁশ কেটে প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিলে তাতে বাঁধ সাজে এলাকাবাসী। এ সময়ে স্থানীয় কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তির আক্রমণের শিকার হন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাসরিন চৌধুরী ও এক নারী পুলিশ সদস্য সেলিনা আক্তার। এসিল্যান্ডের ব্যবহৃত সরকারি গাড়ির একটি গ্লাসও ভেঙ্গে যায়। আহত নারী পুলিশ সদস্যকে মৌলভীবাজার সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

গ্রামের কিশোরী সুমি বেগম জানায়, ‘আমার ভাই আনকার মিয়া ঘটনার দিন আদমপুর বাজারে বেলাল ঠিকাদারের অধীনে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরেন। রাতে পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। এখন আমাদের আয় রোজগার না থাকায় অভাব অনটনে দিন কাটছি।’

বৃদ্ধা দুর্লভজান বিবি বলেন, আমার ছেলে কলেজ ছাত্র মিজানুর রহমান ওই ঘটনায় জড়িত ছিল না। তাকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। তার পিতা বৃদ্ধ আত্তর মিয়া বর্তমানে খুবই অসুস্থ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, এই ইউনিয়নে বসতি স্থাপিত হয়নি এমন অনেক খাসজমি রয়েছে। সেসব স্থানে আবাসন প্রকল্প না করে জনবসতি উচ্ছেদ করে বৃক্ষরাজি কেটে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এসবের নেপথ্যে ইউনিয়নের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান ও তার সহোদর প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান সোলেমান মিয়ার দ্বন্ধের জের হিসাবে এমন ঘটনার জন্ম দিয়েছে। আর পুলিশের অভিযান মনে হয়েছে যুদ্ধের জন্য তারা মাঠে নেমেছে।

গ্রামের হাজির মিয়া, নেওয়ারুন বেগম বলেন, কয়েক ব্যক্তি এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আর ঘটনায় যারা জড়িত নয় অজ্ঞাত কারণে তাদেরও আসামী করায় আতঙ্কিত সবাই বাড়ি তালা দিয়ে চলে গেছে। সরকারি কাজে বাঁধা দেয়ার ঘটনায় যারা জড়িত কেবল তাদেরকেই যেন বিচারের আওতায় আনা হয় প্রশাসনের কাছে তারা জোর দাবি জানান।

ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান বলেন, আগের দিনেও গ্রামবাসী প্রশাসনকে সহযোগিতা করেছে। আর উদ্বোধনের দিনে এমন হামলার ঘটনা প্রমাণ করে তৃতীয় কারো উস্কানি রয়েছে। মূল হামলাকারী সুন্দর মিয়া ঘটনার আগের দিন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুর রহমানের সাথে দেখা করলে চেয়ারম্যান আমার কাছে বিষয়টি জানতে চান। পরদিনই সুন্দর মিয়াসহ কতিপয় ব্যক্তিরা প্রশাসনের লোকদের উপর হামলা করে। তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে নিরপরাধ কেউ যেন অযথা হয়রানির শিকার না হয়। সেই বিষয়ে খেয়াল রাখার জন্য প্রশাসনের প্রতি তিনি জোর দাবি জানান।

ইসলামপুর ইউনিয়নের প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান সোলেমান মিয়া বলেন, সরকার তার ভূমিতে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এখানে আমার কোন লোকের বাঁধা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে রহমান মিয়াসহ মহিলা ইউপি সদস্যরাই সরকারি ভ‚মি দখল করে রয়েছে।

কমলগঞ্জ থানার ওসি আরিফুর রহমান বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করে আটক করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় এমন কাউকে পুলিশ আটক করবে না বলেও জানান ওসি। ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নিরীহ কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, শুধুমাত্র প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বটাই আমার। হামলা-মামলার বিষয়ে আমি কিছু জানি না।

কমলগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) নাসরিন চৌধুরী জানান, ভূমি চিহ্নিত করার দিনেও স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা করেছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য উদ্বোধনের দিনে তারা হামলা চালায়। এতে গাড়ির গ্লাস ভেঙে ও নারী পুলিশ সদস্য আহত হন। পরদিনের হামলার ঘটনায় কারো ইন্ধন থাকতে পারে মনে হচ্ছে। তবে ভিডিও ফুটেজ দেখে মামলায় প্রকৃত ব্যক্তিদেরই আসামী করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক মামলা ও আসামি গ্রেপ্তারের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, বিষয়টি প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন খুবই গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখছে।

 

 

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.