Sylhet Today 24 PRINT

আট বছর ধরে আটকে আছে শাবিপ্রবি’র মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণ

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০

২০১৩ সালের জানুয়ারিতে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদালয়ে (শাবিপ্রবি) মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে ‘মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও মা’-এর ভাস্কর্য স্থাপনের জন্য ভিত্তিও নির্মাণ করা হয়। তবে ভাস্কর্য স্থাপনের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার’ অভিযোগ এনে এর প্রতিবাদে মাঠে নামে উগ্রবাদী গোষ্ঠি। তাদের সাথে যোগ দেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি। এদের প্রতিবাদের মুখে আটকে যায় ভাস্কর্য স্থাপন। আট বছরেও এই ভাস্কর্য আর নির্মাণ হয়নি।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন গোষ্টির আপত্তি এবং এনিয়ে দেশজুড়ে ক্ষোভের মুখে শাবিপ্রবির আটকে থাকা মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে সরকার ‘ইতিবাচক মনোভাব’ প্রকাশ করায় শাবিপ্রবি’র ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ পুণরায় শুরুর দাবি জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

উগ্রবাদী গোষ্ঠির তাৎপরতার কারণে নানা সময়েই আলোচনায় উঠে এসেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার এই বিদ্যাপীট। এরআগে ১৯৯৯ সালে শাবিপ্রবির ছাত্র হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ও ছাত্রী হল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নামে নামকরণ করার সিদ্ধান্ত নেয় সিন্ডিকেট। এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মাঠে নামে জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠি। সিলেটজুড়েই আন্দোলন গড়ে তুলে তারা। ওই আন্দোলনে আব্দুল মুনিম বেলাল নামে শিবিরের এক কর্মী বিজিবি (তৎকালীন বিডিআর)-এর গুলিতে নিহত হন।  সেসময় নামকরণের পক্ষে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ন আহমদ, প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ বিশিষ্টজনেরা শাবিপ্রবির ফটকে এসে অনশন করেন। যা দেশজুড়েই বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। তবে ধর্মভিত্তিক গোষ্টির আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধ ও জাহানারা ইমামের নামে নামকরণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে শাবিপ্রবি প্রশাসন। ২০০০ সালের ৬ মে ৮৯তম সিন্ডিকেট সভায় হলের নামকরণে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি স্থগিতাদেশ জারি করেন।

বিভিন্ন সময় জঙ্গিগোষ্টির তৎপরতাও আলোচনায় এসেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৮ সালের ২ মার্চ ক্যাম্পাসের ভেতরেই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ছুরিকাঘাত করে এক তরুণ। আটকের পর পুলিশ জানিয়েছিলো ‘ইউটিউবে ওয়াজ শুনে বিপথগামী হয়েছিলেন’ সেই তরুণ।

২০১৩ সালের জানুয়ারিতে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে আহ্বায়ক করেই ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণে কমিটি গঠন করা হয়।

ওই কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন- অধ্যাপক ড. ইউনুস, অধ্যাপক ড. রাশেদ তালুকদার, অধ্যপাক সুশান্ত কুমার দাস, অধ্যাপক সৈয়দ হাসানুজ্জামান শ্যামল ও অধ্যাপক মস্তাবুর রহমান।

এই কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, ‘একজন মা তার সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠানো সময় মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করছেন’-এমন থিমে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হচ্ছিলো। ভাস্কর্যটির নকশা চ’ড়ান্ত করে নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছিলো। ৪৫ ফুট উচ্চতার ওই ভাস্কর্যটি নির্মিত হলে এটি হতো দেশের সর্বোচ্চ ভাস্কর্য।

তারা বলেন, ভাস্কর্য নির্মাণ কাজ শুরু পর প্রথমে ক্যাম্পাসের ভেতরের ডানপন্থী গোষ্ঠি এর বিরোধীতা শুরু করে। এরপর শহরের ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের সাথে যোগ দেয়। শহরে ও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন বিক্ষোভ কর্মসূচী পালনের পাশপাশি তারা সরকারের সংশ্লিস্ট দপ্তর ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধে স্মারকলিপি দেয়।

বিজ্ঞাপন



এই গোষ্ঠির তৎপরতা বন্ধে স্থানীয় প্রগতিশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠি তেমন তৎপরত ছিলো না উল্লেখ করে কমিটির সদস্যরা জানান, একপর্যায়ে সরকারের উচ্চমহল থেকে ভাস্কর্য নির্মাণ কাজ বন্ধের নির্দেশনা আসে। এরপর আটকে যায় কাজ।

সরেজমিনে ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চত্বরের পাশে গোলচত্বর হিসেবে পরিচিত জায়গায় ভাস্কর্যের জন্য নির্মিত ইট সিমেন্টের ভিত্তি এখন রয়ে গেছে। দীর্ঘদিন অযত্নে পড়ে থাকার পর সমাবর্তন উপলক্ষে গত বছর এই জায়গার কিছুটা সৌন্দর্যবর্ধণ করা হয়। তবে ভাস্কর্যের জায়গা এখনও ফাঁকা রয়ে গেছে।

তবে এই স্থানে ভাস্কর্য নির্মাণ সম্ভব না হলেও ক্যাম্পাসের একটু ভেতরেই ‘চেতনা ’৭১’ নামে একটি ভাস্কর্য রয়েছে শাবিপ্রবিতে। ২০১২ সালে নির্মিত এই ভাস্কর্য নিয়ে কোনো আপত্তি আসেনি।

শাবিপ্রবির ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ’-এর আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আব্দুল গনি বলেন, এই ক্যাম্পাসে, সিলেট শহরে যেসব স্বাধীনতা বিরোধীরা ভাস্কর্যের বিরোধিতা করেছিল, তারা ও তাদের দোসররাই আজ জাতীয়ভাবে মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে। আমরা চাই আমাদের ক্যাম্পাসের অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের কাজ দ্রুত সমাপ্ত করা হোক।

এ প্রসঙ্গে শাহজালাল বিশজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, আমি এখানে যোগ দেওয়ার আগেই গোলচত্বরের ওই ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে মৌলবাদী গোষ্টি মাঠে নেমেছিলো। পরে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত সবাই এর বিরোধীতা করে। কারণ কারো সঙ্গে আলোচনা না করেই ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিলো। সবার সঙ্গে কথা বলে কাজ করলে হয়তো এই সমস্যা হতো না। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সাংসদ আবুল মাল আবদুল মুহিত ভাস্কর্যের কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। এখন এই কাজ আবার শুরু করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে করতে হবে।
তিনি বলেন, যারা এখন ভাস্কর্যের বিরোধীতা করছে তারা স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। এরা একাত্তরেও ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট করেছে। বাংলাদেশকে এদের থেকে মুক্ত রাখতে হবে।

উপাচার্য বলেন, ভাস্কর্য হলো সৌন্দর্য। এর সাথে ধর্মের কোনো যোগ নেই। আমিও চাই আমাদের ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মিত হোক। তবে আমার মেয়াদকাল প্রায় শেষ হয়ে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন খুব সন্দরভাবে চলছে। তাই শেষ সময়ে এসে আমি কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না। এবিষয়ে তাই সবার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.