Sylhet Today 24 PRINT

কোয়ারেন্টিন মানছেন না প্রবাসীরা, বাড়ছে ঝুঁকি

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ২৪ মার্চ, ২০২১

নতুন ধরনের করোনাভাইরাস (স্ট্রেইন) ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে যুক্তরাজ্য থেকে আসা যাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করে সরকার। এজন্য অনেকগুলো হোটেলের সাথে চুক্তি করা হয়। দেশে এখন ফের বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। করোনার নতুন স্ট্রেইন আক্রান্ত রোগীও শনাক্ত হয়েছে। তবে এমন অবস্থায়ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন মানছেন না যুক্তরাজ্যফেরত প্রবাসীরা। কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতে প্রশাসনের নজরদারিতেও রয়েছে ঢিলেমি। ফলে নতুন স্ট্রেইনের করোনা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।

দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যুক্তরাজ্য প্রবাসী সিলেটে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে আসা যাত্রীদের প্রায় ৯৫ শতাংশই সিলেটের। সিলেটেই যুক্তরাজ্যফেরতরা কোয়ারেন্টিনের নিয়ম সবচেয়ে বেশি ভঙ্গ করছেন। হোটেল নিজ খরচে থাকতে হয় বলে শুরু থেকেই একধরনের নারাজি দেখান প্রবাসীরা। পরে প্রশাসনের কঠোর অবস্থানে হোটেলে থাকতে হলেও কোয়ারেন্টিন মানছেন না তাদের বেশিরভাগই।

হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকাবস্থায় তারা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, শপিং করছেন, রেস্টুরেন্টে খেতে যাচ্ছেন, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, এমনকি কোয়ারেন্টিনে থেকে নিজেরাও আয়োজন করে বিয়ে করে ফেলছেন।

সম্প্রতি নগরের একটি হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় বিয়ে সেরে নিয়েছেন যুক্তরাজ্যফেরত এক প্রবাসী। কোয়ারেন্টিনে থাকা হোটেলের বলরুমেই বিয়ের আয়োজন করা হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে হোটেলের বাইরে থেকে অর্ধশতাধিক অতিথি অংশ নেন। সিলেট নগরের বাসিন্দা কনে বিয়ে পর ওই হোটেলেই স্বামীর সঙ্গে অবস্থান করছেন।

এরআগে সিলেট নগরের একটি হোটেল থেকে কোয়ারেন্টিনে থাকা যুক্তরাজ্যফেরত ৯ জন কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি চলে যান। পরে প্রশাসনের তৎপরতায় তাদের হোটেলে ফিরিয়ে আনা হয়। কেবল এরকম দুটি ঘটনাই নয় বেশিরভাগ প্রবাসীই কোয়ারেন্টিনের নিয়ম না মেনে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তেও কোয়ারেন্টিনের এই বেহাল দশার চিত্র ওঠে এসেছে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রের জানা গেছে, ১৮ মার্চ যুক্তরাজ্য থেকে সিলেটে আসা যাত্রীদের মধ্যে ১১ জনকে নগরের লামাবাজার এলাকার হোটেল লা-ভিস্তায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। এদের মধ্যে দুজন সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার জাঙ্গাইল এলাকার এক নারী (৪৮) ও তার ছেলে আব্দুল মুহি উদ্দিন (২৮)।  হোটেলের ৪০১ নম্বর কক্ষে মা ও ৪০৬ নম্বর কক্ষে ছেলে কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন।

কোয়ারেন্টিনের নিয়ম অনুযায়ী তারা বাইরের বের হওয়া ও বাইরের কারো সাথে সাক্ষাত করা নিষেধ। তবে এমন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঘটা করে করে গত ২০ মার্চ বিয়ে করেন প্রবাসী মুহি উদ্দিন। হোটেলের বলরুমে এই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন বাইরে থেকে আসা প্রায় ৫০ জন অতিথি। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভূরিভোজও হয় হোটেলের রেস্টুরেন্টে।

ওই সূত্র জানায়, ছেলের বিয়ে উপলক্ষে বাইরে বের হয়ে নগরীর বিভিন্ন বিপণিবিতান থেকে কেনাকাটাও করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসী যুবকের মা।  এরআগে ১৮ মার্চ যুক্তরাজ্য থেকে ফেরার দিনই হোটেলের ভেতরে ওই যুবকের আকদ অনুষ্ঠিত হয়। এতেও বাইরে থেকে অতিথিরা এসে অংশ নেন। হোটেল কর্তৃপক্ষের যোগসাজশেই এমনটি ঘটছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও হোটেল কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছেন।

হোটেল লা-ভিস্তার ব্যবস্থাপক তারেক আহমদ বলেন, বিয়ের কোনো আনুষ্ঠানিকতা হয়নি। কেবল আকদ (বিবাহ রেজিস্ট্রি) হয়েছে। এতে কাজিসহ ৪ থেকে ৫ জন মানুষ বাইরে এসে কেবল স্বাক্ষর নিয়েছেন। মানবিক দিক বিবেচনায় সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদেরকে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

হোটেল ব্যবস্থাপক কেবল আকদ হয়েছে বলে জানালেও কাছে বিয়ের আয়োজনের কিছু ছবি পাওয়া গেছে। পুলিশও বিয়ের আয়োজনের সত্যতা পেয়েছে।  

সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) বিএম আশরাফ উল্লাহ তাহের বলেন, লা-ভিস্তা হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকা এক প্রবাসীর বিয়ের আয়োজনের সত্যতা পাওয়া গেছে। হোটেল মালিকও এটি স্বীকার করেছে। কারা কারা এতে উপস্থিত ছিলেন, আয়োজনে কারা সহযোগিতা করেছেন এসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরপর দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশের নজরদারি সত্ত্বেও প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিন ভঙ্গ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুলিশের কাজ হচ্ছে নিরাপত্তা দেওয়া। হোটেল কর্তৃপক্ষ কোন সমস্যা অনুভব করলে পুলিশকে জানাবেন। কিন্তু তারা পুলিশের অগোচরে অন্যান্য অতিথির মতো প্রবাসীদের বিয়ে করায়, বাইরে বের হওয়ার সুযোগ দিয়ে দোষ চাপায় পুলিশের উপর।

এরআগে গত ২১ মার্চ নগরের আম্বরখানা এলাকার হোটেল ব্রিটানিয়ায় কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় উধাও হয়ে যান যুক্তরাজ্যফেরত একই পরিবারের ৯ সদস্য। পরে রাতে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়। তারা রোগী দেখতে জকিগঞ্জ উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন বলে কর্তৃপক্ষকে জানান। এরপর ওই ৯ সদস্যের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ৬ জনকে জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আর ব্রিটানিয়া হোটেলের সাথে প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিনে রাখার চুক্তি বাতিল করে জেলা প্রশাসন।

তবে কেবল এই দুটি ঘটনা বা এই দুটি হোটেলের বিরুদ্ধেই অভিযোগ নয়। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় এমন ঘটনা ঘটছে আরও। বিশেষত কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় বেশিরভাগ যুক্তরাজ্য ফেরতই হোটেলের বাইরে বের হয়ে ঘুরাফেরা ও কেনাকাটা করছেন এবং হোটেলের ভেতরেও বাইরে থেকে আসা স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখাসাক্ষাত করছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।

এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২১ মার্চ নগরের আম্বরখানার ব্রিটানিয়া হোটেলে পরিদর্শনে যান গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই’র দুই কর্মকর্তা। দুপুর আড়াইটারয় ওই হোটেলে গিয়ে তারা যুক্তরাজ্যফেরত ৯ জনকে অনুপস্থিত দেখতে পান। এরপর খোঁজ নিয়ে জানা যায় প্রবাসী ওই পরিবার কাউকে কিছু না বলেই জকিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন।

জানা যায়, ২১ মার্চ ব্রিটানিয়া হোটেল পরিদর্শন শেষে বিকালে নগরের দরগাগেইট এলাকার ‘হোটেল হলি গেট’ পরিদর্শনে যান এনএসআইর ওই দুই কর্মকর্তা। সেখানে গিয়ে ৪ প্রবাসীকে অনুপস্থিত দেখতে পান।

এ ব্যাপারে ব্রিটানিয়া হোটেলের ব্যবস্থাপক কাওসার খান বলেন, সকালে একবার এবং রাতে একবার আমরা কোয়ারেন্টিনে থাকা অতিথিদের রুটিন চেক করি। ওইদিন সকালেও এসব প্রবাসীরা রেস্টুরেন্ট থেকে সকালের নাস্তা গ্রহণ করেছেন। তাই আমরা ধরেই নিয়েছিলাম তারা আছেন। কিন্তু দুপুরে হঠাৎ করে মনে হলো তারা হোটেলে নেই। তখন তাদের খোঁজ করা শুরু করি। এমন সময় এনএসআই’র এক সদস্য এসে উপস্থিত হন।

জানা যায়, বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় বিশেষ প্রয়োজনে সিভিল সার্জনের অনুমতিতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পান প্রবাসীরা। এই সুযোগের অপব্যবহার করে ইচ্ছেমতো বাইরে ঘুরাফেরা করছেন তারা।

নগরের অনুরাগ হোটেলে কোয়ারেন্টিনে ছিলেন যুক্তরাজ্যফেরত ছাতকের এক যাত্রী। কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় গত রোববার জিন্দাবাজার এলাকায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় তাকে। ওই প্রবাসী বলেন, জরুরি প্রয়োজনে ব্যাংকে এসেছিলাম। এখন আবার ফিরে যাবো। তিনি বলেন, আমি তো কাজে বেরিয়েছি। কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রায় সকলেই বিনাকাজেও ঘুরে বেড়াচ্ছে।

প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিয়ে এমন নানা অভিযোগের পর এবার কঠোর হচ্ছে প্রশাসন। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আ.ন.ম. বদরুদ্দোজা বলেন, আমরা এসব বিষয়ে কঠোর হচ্ছি। কোয়ারেন্টিন যাতে সঠিকভাবে মেনে চলা হয় তা নজরদারি করা হবে। কিন্তু সকল কিছুর উর্ধ্বে সচেতনতা। চাইলেই আমরা কারো সাথে আসামির মত আচরণ করতে পারি না। সে ক্ষেত্রে প্রবাসীদের সহযোগিতা করতে হবে। আর ব্রিটানিয়া হোটেলের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। লাভিস্তায় বিয়ের বিষয়ে অবগত হয়েছি। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.