Sylhet Today 24 PRINT

রায়হান হত্যা: সাত মাস পর জট খুলছে

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ০৫ মে, ২০২১

অবশেষে প্রায় সাত মাস পর জট খুলতে যাচ্ছে সমসাময়িক সময়ে সিলেটের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড রায়হান আহমদ হত্যার। আজ বুধবার এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে প্রদান করবে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

এ তথ্য জানিয়ে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ-উজ-জামান বলেন, ১১টায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে। এরপর দুপুর ১২টায় সিলেটে পিবিআই কার্যালয়ে অভিযোগপত্র নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করা হবে।

দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে আলোচিত এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র ঘোষণার খবরে স্বস্থি প্রকাশ করেছেন রায়হান আহমদের মা সালমা বেগম। তবে অভিযোগপত্রে যাতে কোনাভাবেই কাউকে রক্ষার করার চেষ্টা করা না হয়, জড়িত সকলের নাম যুক্ত করা হয় এমন দাবিও জানিয়েছেন তিনি।

রায়হান হত্যার ঘটনাক্রম: নরেরর আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কাষ্টঘর সুইপার কলোনি থেকে তাকে ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যান এই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ও তার সহকারীরা। এরপর কয়েক ঘণ্টা চলে নির্যাতন। শেষ রাতে এক পুলিশ সদস্যের মোবাইল থেকে নিজের চাচাকে ফোন করে রায়হান। এসময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্রুত ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসার জন্য চাচাকে অনুরোধ করে। ভোরের ফজরের নামাজের পূর্ব মূহূর্তে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে হাজির হন চাচা। তবে তখন তাকে রায়হানের সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এরপর ১১ অক্টোবর সকালে আবার চাচা ফাঁড়িতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়হানকে ওসমানী হাসপাতপালে পাঠানো হয়েছে। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে রায়হানের মরদেহ দেখতে পায় পরিবার।

ভিন্নখাতে প্রবাহিতের চেষ্টা: রায়হানের মৃত্যু জানাজানি হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, কাষ্টঘর এলাকায় ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন রায়হান। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেছে। বন্দুর বাজার ফাঁড়ির কর্মকর্তা ও সিলেট মহানগর পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সকাল থেকে গণমাধ্যমে এমন খবরও প্রকাশ হয়।

পরিবার ও এলাকাবাসীর বিক্ষোভ : নগরীতে গণপিটুনিতে ছিনতাইকারীর মৃত্যু- বিভিন্ন গণমাধ্যমে যখন এমন খবর প্রকাশ হচ্ছিলো, তখন ভিন্ন তথ্য নিয়ে সামনে আসে নিহত যুবক রায়হান আহমদের পরিবার ও আখালিয়া এলাকাবাসী।

রায়হানের বাসার সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে তারা জানান, ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে টাকার জন্য নির্যাতন চালিয়ে রায়হানকে হত্যা করেছে পুলিশ।

পরিবারের এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ হয়। এতে পর নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। আর পরিবার ও এলাকাবাসীর মাধ্যমে শুরু হওয়া রায়হান হত্যার বিচার দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো সিলেটজুড়ে।

পুলিশের উদ্যোগ: ফাঁড়িতে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠার পর মহানগর পুলিশের পক্ষে থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় বন্দরবাজার ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভ’ইয়াসহ ৪ পুলিশ সদস্যকে ১২ অক্টোবর সাময়িক বহিস্কার করা হয়। এরআগে ১১ অক্টাবর রাতেই হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। এরপর আরও চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়।

তদন্তে পিবিআই, আকবর পলাতক: পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠার পর কতোয়ালি থানা থেকে এই মামলা তদন্তের ভার দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)কে। তদন্তের দায়িত্ব পেয়েই তারা রায়হানের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে পুণরায় ময়না তদন্তের উদ্যোগ নেয়। দুই ময়না তদন্ত রিপোর্টেই রায়হানের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।

এরপর পিবিআই বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করে  বন্দরবাজার ফাঁড়ির কর্মকর্তা এসআই হাসান আলী, এএসআই আশেকে এলাহী, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, কনস্টেবল তৌহিদ মিয়া ও কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস। এদের সকলকেই আগে বহিস্কার করে সিলেট মহানগর পুলিশ।

এদিকে, সাময়িক বহিস্কার হওয়ার পর পুলিশ, লাইনে সংযুক্ত থাকা অবস্থায় পালিয়ে যান বন্দরবাজার ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই (বহিস্কৃত) আকবর হোসেন ভূঁইয়া। তিনি ভারতের মেঘালয়ে পালিয়ে যান বলে অভিযোগ ওঠে।

আকবর গ্রেপ্তার: নানা সমালোচনা ও তীব্র আন্দোলনের মুখে গতবছরের ৯ নভেম্বর কানাইঘাট সীমান্ত থেকে আকবরকে গ্রেপ্তার করে সিলেট জেলা পুলিশ। ভারতে পালানোর সময় সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে আটক করে বলে সেসময় জানিয়েছিলেন সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন।

তবে আরেকটি সূত্র জানায়, ভারতের সীমান্তের ভেতরে স্থানীয় খাসিয়ারা আকবরকে আটক করে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে এসে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। আকবরকে কানাইঘাট সীমান্তের ওপারে ভারতের একটি খাসিয়া পল্লীতে আটকের একটি ভিডিও ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে।

আকবরকে গ্রেপ্তারের পরদিন ১০ নভেম্বর তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয় পিবিআই। এরআগে এই ঘটনায় গ্রেপ্তার অন্য পুলিশ সদস্যদেরও রিমান্ডে নেওয়া হয়। তবে রিমান্ড শেষে তারা কেউই আদালতে স্বীকারোক্তিমলক জবানবন্দি দেননি।

সিলেটজুড়ে তীব্র আন্দোলন: পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যার পর এই ঘটনার বিচার দাবিতে সিলেটজুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। রাস্তায় নেমে আসে সবশ্রেণীর মানুষ। আকবর পালিয়ে যাওয়োর পর এ আন্দোলন আরও তীব্র হয়। পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আকবর পালিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এতে তীব্র ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়ে সিলেট মহানগর পুলিশ। সমালোচনার মুখে সিলেট মহানগর পুলিশের তৎকালীন কমিশনার গোলাম কিবরিয়াকেও বদলি করা হয়।

অবশেষে অভিযোগপত্র: মামলার তদন্তকাজে দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ে পিবিআই। তদন্তকারী সংস্থাটির পক্ষ থেকে একাধিকবার অভিযোগপত্র প্রদানের ঘোষণা দিয়েও পরে তা দেওয়া হয়নি। এনিয়ে ক্ষোভ দেখা দেয় রায়হানের পরিবারে। অবমেষে হত্যাকান্ডের প্রায় সাত মাস পর আজ এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দিতে যাচ্ছে পুলিশ। এতে চাঞ্চল্যকর এই হত্যার ঘটনার জট খুলবে বলে আশা সংশ্লিস্টদের।

পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ-উজ জামান বলছেন, অভিযোগপত্রকে যাতে কোনো খুঁত না থাকে, যাতে তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে এজন্য তদন্তে সবগুলো দিক খতিয়ে দেখা হয়েছে। একারণে কিছুটা সময় লেগেছে।

তিনি বলেন, আলোচিত এ মামলাটির আসামি পুলিশ হওয়ায় একটি নির্ভূল, ত্রুটিমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য চার্জশীট তৈরি করতে কিছুটা সময় লেগেছে। এছাড়া করোনার বিরূপ পরিস্থিতির কারণেও কিছুটা দেরী হয়েছে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.