Sylhet Today 24 PRINT

‘প্রচলিত পদ্ধতিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়’

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ০৪ জুলাই, ২০২২

এবার নজিরবিহীন বন্যায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা উদ্বেগজনক। যথাযথ প্রদক্ষেপ না নিলে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি বার বার হতে পারে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রচলিত ব্যবস্থায় এরকম পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যাবেনা। এমতাবস্থায় সিলেট অঞ্চলকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় অংশীজনের মতামত নিয়ে স্থায়ী সমাধানের উপায় বের করতে হবে।

সোমবার (৪ জুলাই) বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে সিলেট বিভাগ সাংবাদিক সমিতি (সিবিসাস), ঢাকা আয়োজনে এবং অল ইউরোপিয়ান বাংলা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় ‘সিলেট অঞ্চলে ঘন-ঘন বন্যা : কারণ, পুনর্বাসন ও স্থায়ী সমাধান’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত চারজন মন্ত্রী বিশেষজ্ঞদের মতামতকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বিশেষজ্ঞদের মত নিয়েই পরবর্তী উদ্যোগ নেয়া হবে। ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হবে। বাড়ি-ঘর নির্মাণ ও কৃষকের জন্য সার বীজ বিতরণ করা হবে।

সিবিসাসের সভাপতি আজিজুল পারভেজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম।

বিশেষজ্ঞ আলোচক হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন- পদ্মা সেতু প্রকল্প বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য ও বুয়েটের সাবেক বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও ডিন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম ফিরোজ আহমেদ, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভূতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মতীন উদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-আইপিডির পরিচালক মো. আরিফুল ইসলাম, রিভার এন্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। অনুষ্ঠানে দুর্গত এলাকার ত্রাণ বিতরণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন প্রতিদিনের বাংলাদেশের সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি ও জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি সৈয়দ জগলুল পাশা। অনুষ্ঠানে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন গোলটেবিল আয়োজন কমিটির আহŸায়ক এহসানুল হক জসীম। স্বাগত বক্তব্য দেন সহ-সভাপতি নিজামুল হক বিপুল।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, এবারের বন্যায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছে, সে তুলনায় জীবনহানি তুলনামূলক কম হয়েছে। তবে স্কুল কলেজ ও পথঘাট যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই ক্ষতি কত দিনে কাটিয়ে উঠতে পারব, তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।

হাওরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও সড়ক নিয়ে চলমান নানা সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, আপনারা বাউল গান শুনতে হাওরে যাবেন, বজরায় টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরবেন, ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া আরও নানা জায়গায় ভালো থাকবেনৃ আর হাওরের মানুষ গলাপানিতে ডুবে থাকবে তা কি করে হয়? তারাও তো ভালো জীবনের প্রত্যাশা করে।

তিনি জানান, বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ভাবছে সরকার। কৃষি পুনবার্সন প্রকল্পে কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষকদের সার ও বীজ সরবরাহ করবে। হাওর অঞ্চলে সিলেটের খাসিয়াদের মতো বাঁশের মাচাংয়ের ওপর ঘর নির্মাণ করা যায় কি না তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

বন্যা প্রতিরোধে দেশের খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওর, বিলসহ অন্যান্য জলাশয় খননে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে জানিয়ে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন বলেন, জলাশয়সমূহের পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে পারলে বন্যার তীব্রতা কমানো সম্ভব হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমাতে পরিবেশ সংরক্ষণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। অবাধে বৃক্ষ নিধন, পাহাড়, টিলা কর্তন বন্ধ করতে হবে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী সুরমা ও কুশিয়ারার নদীপথ পুনরায় চালু করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকারের বিশেষ উদ্যোগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।  যেকোনো দুর্যোগে অসহায় মানুষের সহযোগিতায় সমাজের সামর্থ্যবানদের এগিয়ে আসার আহবান জানান মন্ত্রী ।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, এবারের বন্যায় সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল। বলা যেতে পারে, যে প্রস্তুতি ছিল তা আপ টু মার্ক ছিল না। তবে এতে সরকারকে যে পুরোপুরি দোষারোপ করা যাবে তা কিন্তু না। কারণ এবার যে এমন বন্যা হবে তা ছিল অনভিপ্রেত।

তিনি বলেন, এখন যারা ত্রাণ বিতরণের জন্য অর্থ সাহায্য করছেন, তা জমিয়ে রাখুন। সরকারে পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডে সে অর্থ বিনিয়োগ করুন।

পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, আমাদের ২৫টি আন্তঃসীমান্ত নদীর তথ্য শুধু রয়েছে। আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলেছি, আমাদের ৫৪টি নদীর তথ্যই লাগবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে সিলেটে। সিলেটে ১২০ কোটি ৮১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, সুনামগঞ্জে ১৯১ কোটি ৬৩ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা, মৌলভীবাজারে ৯৯৬ কোটি টাকা, হবিগঞ্জে ৫৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্যানেল বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম ফিরোজ আহমেদ বলেন, আমরা অজান্তে আমাদের বিল এরিয়া বা যেগুলোকে জলাশয় বলি, সেগুলোকে ভরাট করে আমরা কৃষিজমি করে ফেলছি। আমরা মনে করি, কৃষিজমি হলে ব্যক্তি পর্যায়ে লাভজনক হওয়া যায়। কিন্তু আমরা জানি না, জলাভূমির আউটপুট কোনো অংশে কম না। হাওর এলাকার যেসব রাস্তা পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে, সেগুলো সংকুচিত করে প্রয়োজনে ব্রিজগুলো ওপেন করে দিতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশন আইনবিদ সমিতি-বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আগামীতে কপ-২৭ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। পাশাপাশি ভবিষ্ৎ বিবেচনায় বাংলাদেশকে জাতিসংঘের অভিন্ন জলাশয় চুক্তিতেও স্বাক্ষর করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দীন আহমেদ বলেন, আমরা নদী দখল করছি, কিন্তু নদীর জন্য জায়গা ছাড়ছি না। ৯০ সালে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর নেদারল্যান্ড নদী শাসন করতে গিয়ে যেটা করল, তা হল তারা নদীর আশপাশে স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে নদীর মূল ভূমির যেন কোনো পরিবর্তন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

সিলেট, সুনামগঞ্জ অঞ্চলে রংধনু গ্রুপ ও প্রতিদিনের বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করেন সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি। ত্রাণ বিতরণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা যে ত্রাণ দিয়ে এসেছি তাতে এক পরিবারে সপ্তাহ চলে যাবে। কিন্তু এতে মানুষের সমস্যা কমবে না, তিন-চার মাস ধরে এই পরিস্থিতি চলমান থাকবে। এখন বেসরকারি ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি পুনবার্সন কাজে সরকারি তৎপরতা বাড়াতে হবে।

জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ জগলুল পাশা বলেন, বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে এখন নজর দিতে হবে পুনবার্সন প্রকল্পে। আমরা জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের জন্য এমন কিছু মডেল হাউজ নির্মাণ করে দেব, পরে যা স্থানীয় প্রশাসনও বাস্তবায়ন করতে পারে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, হাওরে এলজিইডি যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে তা ওই এলাকার নদীর হাইড্রোলজির কথা চিন্তা না করেই করেছে। হাওরে যে ১২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো অপটিমাইজ করে এখন নতুন করে সেই রাস্তাগুলো সংযুক্ত করতে হবে জাতীয় সড়কের সঙ্গে।

ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-আইপিডির পরিচালক মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, হাওর এলাকায় যেসব উন্নয়ন কর্মকাÐ ভবিষ্যতে গ্রহণ করা হবে, তাতে প্রতিবেশ ও পরিবেশ কোনোভাবেই যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। পাশাপাশি হাওর এলাকার জলাশয় ও নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতেও উদ্যোগ নিতে হবে।

হাওর এলাকার উন্নয়ন কর্মকাÐের যে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়, তা বন্যার কারণে বাধাগ্রস্ত হয় বলে আলোচানয় উল্লেখ করেন রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, মেঘনা অববাহিকায় ভারতের আন্তঃসীমা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আমাদের ক‚টনীতিক দুর্বলতা রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের ৫৪ টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে কী পরিমাণ পানি প্রবাহিত হচ্ছে, তা নিয়ে সঠিক তথ্যউপাত্ত আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডে পাই না। যাই হোক, আমরা মনে করি, এই ইস্যুতে যৌথ নদী কমিশনকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.