Sylhet Today 24 PRINT

কমিউনিটি ট্যুরিজমে পথ দেখাচ্ছে কমলগঞ্জের যে গ্রাম

প্রণিত দেবনাথ, কমলগঞ্জ |  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

মনিপুরী নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত গ্রাম মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুর ইউনিয়নের ভানুবিল মাঝেরগাঁও। চার বছর আগে এই গ্রামে শুরু হয়েছিলো কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম। যাতে এখন যুক্ত রয়েছে গ্রামের ৭৫টি পরিবার। বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমে দেশে উদাহরণ হতে পারে এই গ্রাম।

জানা যায়, ২০১৮ সালের ৩ জুন সিলেটের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার নাসমানা খানম এ গ্রামের নিরঞ্জন সিনহা রাজুর বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছিলেন মণিপুরি কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম। শুরুতে ১০ মণিপুরি পরিবার সদস্যদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন এ গ্রামের ৭৫টি বাড়িতে গড়ে উঠেছে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম। দেশি বিদেশি পর্যটকরা এতে একেবারে পারিবারিকভাবে অবস্থান করে একে অন্যের খাবার, সামাজিকতা, সংস্কৃতি আচর-আচরণ, সামাজিক পরিবেশ ইত্যাদি বিনিময় করার সুযোগ পাচ্ছেন। করোনার সময়ে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম অনেকটা থমকে গেলেও আবারও ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছে এখানকার কার্যক্রম।

যেভাবে শুরু:
নিরঞ্জন সিনহার ভগ্নীপতি থৌরেম রবিন ঢাকায় মণিপুরি তাঁতবস্ত্রের একটি কারখানা পরিচালনা করেন। সেখানে থেকে তিনি তাঁতবস্ত্র রপ্তানি শুরু করে জাপানে। জাপানি ক্রেতারা সেখান থেকে সরাসরি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুরের ভানুবিল মাঝের গাঁও এসে একেবারে গ্রামীণ পরিবেশে মণিপুরি তাঁতবস্ত্র তৈরি ও এখানকার সামাজিক অবস্থান দেখে মুগ্ধ হন। তাদের এ আসা যাওয়ার সূত্র ধরে নিরঞ্জন সিনহা নিজ বাড়িতে বিদেশি (জাপানি) পর্যটকদের রেখে তাদের এখানকার পর্যটন এলাকা ঘুরিয়ে দেখাতেন। এরপর বিদেশি পর্যটকরা মণিপুরি বাড়িতে বসবাস করে মণিপুরি খাবার দাবার, সামাজিকতা, আচার আচরণ, সংস্কৃতি, আতিথেয়তা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হন। আর মণিপুরি পরিবারগুলোও বিদেশি পর্যটকদের খাবার দাবার, সামাজিকতা, সংস্কৃতি, আচার আচরণ ও পরিবেশ সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়।

 
নিরঞ্জনের পরিচিত ব্যবসায়ী শামীম আহমেদ তাদের প্রয়োজনে ভানুবিল গ্রামে এসে মণিপুরি পরিবারে পর্যটকদের রেখে পর্যটন উন্নয়ন দেখে মুগ্ধ হয়ে বিষয়টি সিলেট বিভাগীয় কমিশনারকে অবহিত করলে বিভাগীয় কমিশনার নাসমানা খানম ২০১৮ সালের ৩ জুন এখানে এসে মণিপুরি কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমের উদ্বোধন করেন। সাথে সাথে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সাথে এটিকে যুক্ত করে প্রথমে ১০টি মণিপুরি পরিবার নিয়ে পর্যটন উন্নয়নে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন। এখন ভানুবিল গ্রামে ৭৫টি পরিবারে গড়ে উঠেছে মণিপুরি কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম। ট্যুরিজম বোর্ডের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় দেশের বিভিন্ন ট্যুর গাইডদের সাথেও মণিপুরি কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম যুক্ত হয়েছে। পর্যটকরা এখানে গ্রাম্য পরিবেশে দূষণমুক্ত ভাবে বেড়ানোর ও খাবার দাবারের সুযোগ পায়। এখানে পর্যটকদের প্রয়োজনে স্বল্পাকারে মণিপুরি সংস্কৃতি তুলে ধরে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজনও করা হয়।

একই সাথে প্রতিটি কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম পরিবারে রয়েছে মণিপুরি তাঁত বস্ত্র, তাঁতবস্ত্র তৈরির প্রদর্শনী তাঁত, মণিপুরি মিনি যাদুঘর। অবসর সময়ে ঘরে বসে পড়ার মত সু-ব্যবস্থা।

পর্যটকদের ব্যয়:
মণিপুরি বাড়িতে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমে ৪ জনের পারিবারিক পরিচ্ছন্ন কক্ষে মাত্র ২ হাজার টাকায় থাকতে পারছেন। ৩ বেলা খাবারে আগে ৭শত টাকা ব্যয় হলেও দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এখন খাচ্ছেন ৯শত টাকায়। এ ট্যুরিজমে একেবারে ভিন্ন পরিবেশে পর্যটকদের মুড়ির মোয়ার সাথে হারবাল চাও পরিবেশন করা হয়। খাবারে নিজেদের উৎপাদিত বিষমুক্ত শাক সবজি ব্যবহার করা হয়। ৪ জনের কক্ষে যদি একজন পর্যটক থাকেন তা হলে তাকে দিতে হয় মাত্র ১ হাজার টাকা,  তবে সেটা আলোচনার মাধ্যমে।


নিরাপত্তা :
কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমে প্রশাসনিক সহায়তার সাথে পর্যটন পুলিশেরও নজরদারি থাকে। এখানে অহেতুক প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। মণিপুরি পরিবারের নারীরা বাড়িতে পর্যটকদের সেবাযত্ন ও রান্নার কাজ করেন। আর পুরুষ সদস্যরা হাটবাজার করার সাথে পর্যটকের পছন্দের মাধবপুর লেক, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ, স্মৃতি যাদুঘর, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, হামহাম জলপ্রপাত এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরতে ব্যবস্থা করা ছাড়াও সাথে থাকেন। এছাড়াও সামান্য দূরে ত্রিপুরা সীমান্ত এলাকা থাকায় এসব গ্রামের সবুজ পরিবেশও পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

কৃষিপ্রধান এলাকা উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের ভানুবিল গ্রামে গেলে মণিপুরি কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমের নিরঞ্জন সিনহা বলেন, এ ব্যবস্থাপনায় পর্যটকরা এ পরিবেশে থাকতে বেশি পছন্দ করে। করোনার থাবা কাটিয়ে উঠে এখন বিদেশি পর্যটকরা এখানে আসতে চাচ্ছে। পারিবারিকভাবে পর্যটকদের থাকা খাওয়ার সুযোগে নেই কোন নেশা গ্রহণের সুযোগ। পর্যটক ও মণিপুরি পরিবার সদস্যরা সবাই নিজ নিজ একটি অবস্থান থেকে অবস্থান করায় উভয় পক্ষের থাকে সামাজিকও পারিবারিক নিরাপত্তা।  


তিনি আরও বলেন, ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর  ভারতের মণিপুর রাজ্য থেকে ১৭০ জনের একটি পর্যটক দল আসার জন্য বুকিং করেছে। তিনি মনে করেন আগামী এক বছরে এখানে ১ হাজার পর্যটক আসবে ভারত থেকে। এর মাঝে বেশি আসবে ভারতের মণিপুর থেকে।

আসবেন কীভাবে:
দেশের যেকোনো  স্থান থেকে আন্তঃনগর ট্রেনে কমলগঞ্জের ভানুগাছ রেলওয়ে স্টেশন ও অথবা শমশেরনগর রেলওয়ে স্টেশনে অবতরণ করে প্রাইভেট কার, সিএনজি বা অটোয় করে আদমপুরের ভানুবিল গ্রামে যাওয়া যায়। সড়ক পথেও সহজে ভানুবিল গ্রামে যাতায়াত করা যায়। কমলগঞ্জ উপজেলার সদর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরত্বের ভানুবিল গ্রামে যাওয়া যায়।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.