Sylhet Today 24 PRINT

সিলেটে পর্যটনের পথে যত বাধা

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

পাহাড়, ঝর্ণা, নদী, হাওর, অরণ্য, চা বাগান কিংবা জলারবন- কী নেই সিলেটে? দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো মানুষের অভাবও কখনও হয়নি এখানে। তবে ইদানীং সেই আগ্রহে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

করোনার প্রকোপ আর কয়েদফা বন্যা ছাড়াও নানা সমস্যার কারণে এবার জেলায় আশানুরুপ পর্যটক আসছে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

সেই সমস্যাগুলো কী কী- এই প্রশ্নে তারা ভাঙাচোরা সড়ক, অনুন্নত অবকাঠামো, নিরাপত্তাহীনতা, পরিকল্পনা ও প্রচারের অভাব, দক্ষ জনশক্তি না থাকার কথা তুলে ধরেন।

ভাঙা সড়ক

চলতি বছরে কয়েকদফা বন্যা হয় সিলেট। পানি নেমে গেলেও তার ক্ষত রয়ে গেছে। নগরসহ সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগ সড়ক ধরে চলাই এখন কষ্টকর।

জেলার দুটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র বিছনাকান্দি ও রাতারগুল জলারবন। এই দুই স্থানে যাওয়ার সড়ক এখন ভাঙাচোরা। ফলে এসব স্থানে ভোগান্তিতে পড়ছেন পর্যটকরা।

বিছনাকান্দির দূরত্ব সিলেট থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার। এই পথের মধ্যে গোয়াইনঘাট উপজেলার বঙ্গবীর রোড থেকে হাদারপাড় পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। বন্যায় পিচ উঠে বড় বড় যেসব গর্ত তৈরি হয়, সেগুলো এখন পর্যন্ত সংস্কার হয়নি।

রাতারগুলের অবস্থান সিলেট থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে। এ সড়কের পাঁচ কিলোমিটার অংশ ভাঙাচোরা। আবার চানুপুর থেকে মোটরঘাট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার সড়ক কাঁচা। এ কারণে বৃষ্টির দিনে যাতায়াতে সমস্যা হয় ব্যাপক। অটোরিকশা আর লেগুনা ছাড়া কোনো গাড়িই যেতে চায় না রাতারগুল ও বিছনাকান্দিতে।

গত শনিবার চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের বিছানাকান্দিতে বেড়াতে আসা সাদমান সাকিব বলেন, ‘সিলেটের প্রকৃতি খুবই সুন্দর। পাহাড়, নদী, হাওর, ঝর্ণা, বন- সবই আছে এখানে। কিন্তু নগর থেকে পর্যটনস্পটগুলোতে আসার সড়কগুলো ভয়াবহ রকমের খারাপ। এই সড়কগুলোই সিলেটের পর্যটনের পথের কাঁটা হয়ে আছে। কেউ একবার আসলে আর কোনোদিন আসতে চাইবে না।’

একই মত বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের সাবেক সদস্য জাকারিয়া আহমদেরও। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভাঙাচোরা সড়কের কারণে সিলেটে আশানুরূপ পর্যটক আসছেন না। ফলে এখন পর্যটকরা সিলেটে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে সিলেট হয়ে ভারতের মেঘালয়েই বেশি যাচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘কেবল দামি দামি রিসোর্ট করলেই তো পর্যটকরা আসবে না। পর্যটকরা রিসোর্ট দেখতে আসে না। তারা ছুটি কাটানোর জন্য, একটু আরাম আয়েশের জন্য বেড়াতে আসেন। অথচ সিলেটে বেড়াতে এসে তাদের দূর্ভোগ পোহাতে হয়।’


নেই অবকাঠামো

জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ। সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কটিও অপেক্ষাকৃত ভালো। তবে সাদাপাথরে পর্যটকদের জন্য ওয়াশ রুম, চেঞ্জ রুমসহ অবকাঠামোগত সুবিধা। বিছানাকান্দি, রাতারগুলসহ সিলেটের বেশিরভাগ পর্যটন কেন্দ্রে নেই এমন সুবিধা।

সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালি বিভাগের প্রভাষক আব্দুল হালিম বলেন, ‘সিলেটের বেশিরভাগ পর্যটনকেন্দ্রে কোন বিশ্রামাগার ও ওয়াশরুম নেই। এতে পর্যটকরা এসব স্থানে এসে বিপাকে পড়েন। কেবল পর্যটন এলাকায় নয়, ওইসব স্থানে যাওয়ার পথেও ওয়াশরুম নির্মাণ করা প্রয়োজন।

‘স্পটগুলোতে কোন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও নেই। ফলে পর্যটকরা অনেক সময় পর্যটন এলাকা নোংরা করে ফেলেন। পর্যটন শিল্পের বিকাশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও জরুরি।’

অবকাঠামো গড়ে তোলার নামে যাতে পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস করা না হয় সেদিকে নজর রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সহ-সভাপতি এমাদউল্লাহ শহীদুর ইসলাম শাহীন।

তিনি বলেন, ‘রাতারগুল জলারবন একটি বিশেষ প্রকৃতির বন। অথচ এই বনের ভেতরে বনবিভাগ পর্যটক আকর্ষণের নামে ওয়াচ টাওয়ার নির্মণ করেছে। যা কেবল অপ্রয়োজনীয় নয়, বনের চরিত্রবিরোধীও। বন, হাওরের উন্নয়ন হবে স্থাপনাবিহীন।’

তিনি বলেন, ‘বন ও হাওরের মধ্যে ইঞ্জিন নৌকা চলাচলও বন্ধ করা দরকার। সিলেট অঞ্চলে বারকি নৌকা নামে হাতে টানা এক ধরনের বিশেষ নৌকা রয়েছে। এটা সিলেটের ঐতিহ্যও। পর্যটক চলাচলে এসব নৌকা ব্যবহার করা যেতে পারে।’

পরিবহনখাতে অব্যস্থাপনা ও নিরাপত্তাহীনতা

পরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনার কারণেও পর্যটকদের দুর্ভোগে পরতে হয়। অ্যাপসভিত্তিক পরিবহন সেবা এখানে জনপ্রিয় না হওয়ায় পর্যটকদের কাছ থেকে ইচ্ছেমত ভাড়া হাকান চালকরা। মাঝিরা নৌকা ভাড়াও বাড়তি রাখেন বলে অভিযোগ আছে।

হাওর পর্যটন নিয়ে গবেষণা করা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইমদাদুল হক, ‘এখানকার চালকরা সিলেটে মানুষ না হলে ভাড়া বেশি রাখেন। এছাড়া ভাড়া গাড়ি নেয়ার মতো কোনো কাউন্টার বা টিকিটের ব্যবস্থা নেই। ফলে যাত্রীদের যেমন বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়, তেমনি নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কায় থাকতে হয়।’

একই মত জানিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশরাফুল কবীর বলেন, ‘নৌকা ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। একইসঙ্গে সেগুলোকে নিবন্ধন ও নজরদারির আওতায় আনা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর জাফলং ও লালাখালে পানিতে ডুবে অনেক মৃত্যু হয়। প্রতি বছর এমন ঘটনা ঘটলেও পর্যটকদের নিরাপত্তায় তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। পর্যটন পুলিশ বলে একটি বিশেষ ইউনিট থাকলেও তাদের তেমন কার্যক্রম চোখে পড়ে না।’

পর্যটন কেন্দ্রগুলোর নৌকার ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে জানিয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান বলেন, ‘বিছনাকান্দি, রাতারগুলসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র্রে নৌকা ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি নৌকায় লাইফ জ্যাকেট রাখতে বলা হয়েছে। এছাড়া সাঁতার না জানা কেউ পানিতে না নামার অনুরোধ জানিয়ে সাইনবোর্ডও টানানো হয়েছে।’

প্রচারের অভাব, তথ্যের দুস্প্রাপ্যতা

সিলেটের প্রচার বা ব্র্যান্ডিং নেই বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এখানে এলে কোথায় কীভাবে ঘুরে বেড়ানো যাবে, এ নিয়ে সঠিক তথ্যও এক স্থান থেকে পাওয়ার ব্যবস্থা নেই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সহ-সভাপতি এমাদউল্লাহ শহীদুর ইসলাম শাহীন বলেন, ‘ধর্মীয় পর্যটন সারাবিশ্বেই পর্যটনের অন্যতম একটি শাখা। সিলেটেও এর সুযোগ ছিল। কিন্তু প্রচারের অভাবে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

‘এখানে শাহজালাল (র.) শাহপরান (র.) সহ ৩৬০ আওলিয়ার মাজার রয়েছে। শ্রীচৈতন্যের পিতৃভূমি রয়েছে। কিন্তু এগুলো কোথায় অবস্থিত, কোনটি কী বৈশিষ্ট্য তা নিয়েও প্রচার নেই।’

তিনি বলেন, ‘নগরের চাষনী পীর এলাকার মাজারে প্রচুর বানর রয়েছে। এটি ভালোভাবে প্রচার করা হলে পর্যটকরা সেখানে যেতেন। আবার অনেক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও প্রত্মতাত্ত্বিক নির্দশন রয়েছে। এগুলো সংরক্ষণ ও ভালোভাবে ব্র্যান্ডিং করা গেলেও অনেক পর্যটক আসতেন।’

পর্যটকদের জন্য আলাদা একটি তথ্য বাতায়ন গড়ে তোলা প্রয়োজন জানিয়ে সিলেট ইতিহাস ও ঐতিহ্য ট্রাস্টের সভাপতি শাহ জামান মোস্তফা বাহার বলেন, ‘সিলেটে যারা বেড়াতে আসেন তারা কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন, এখানে ঘুরে দেখার মতো কী কী আছে এসব ব্যাপারে এক জায়গা থেকে তথ্য পাওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে পর্যটকদের বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞেস করে ঘরে বেড়াতে হয়। এতে তারা অনেক সময় বিপত্তিতে পড়েন।’

দক্ষ জনশক্তির অভাবও সিলেটের পর্যটন বিকাশের অন্যতম বাধা বলে মনে করেন সিলেট ক্যটারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন বাবলু। তিনি বলেন, ‘এখানে হোটেল ম্যানেজমেন্ট, হসপিটালি, রেস্টুরেন্ট, ট্যুর অপারেটর বা ট্যুর গাইড হিসেবে দক্ষ মানুষজন পাওয়া যায় না। এসব খাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন ‘

যা বলছেন দায়িত্বশীলরা

এসব সমস্যা সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান বলেন, ‘আমরা একটা ওয়েবসাইট করব। যেখানে পর্যটকরা সিলেট সম্পর্কে সব তথ্য পাবেন।’

তিনি বলেন, ‘বন্যায় সিলেটের বেশিরভাগ সড়কেরই ক্ষতি করেছে। এসব সড়ক সংস্কারের একাধিক প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে।’

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সিলেটে সবই আছে। প্রকৃতি আমাদের সবই দিয়েছে। আমাদেরকে এগুলোর সদ্ব্যবহার করতে হবে। কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। এগুলো দূর করতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এখানকার মানুষজনকেও সচেতন হতে হবে, পর্যটকবান্ধব হতে হবে।

‘পরিবেশ রক্ষায় আমরা জাফলং ও ভোলাগঞ্জ থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ করেছি। কিন্তু কিছু সংখ্যক মানুষ পাথর উত্তোলন শুরুর জন্য দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকে লুকিয়ে তুলছেও। তাদের বুঝতে হবে পাথর থেকে পর্যটন আয়ের বড়ক্ষেত্র হতে পারে। তাদের পেশা পরিবর্তন করার মানসিকতা থাকতে হবে।’

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.