নিজস্ব প্রতিবেদক | ০৩ জুন, ২০২৩
২০২০ সালের ডিসেম্বরে নগরের আম্বরখানা এলাকায় সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্মাণাধীন একটি খোলা ড্রেনে পড়ে মারা যান কবি আব্দুল বাছিত মোহাম্মদ। এ ঘটনায় অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে চালানো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। উচ্চ আদালতেও এ নিয়ে রিটও হয় তখন।
তবু বোধোদয় হয়নি সিসিকের। বরং কোনরূপ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছে উন্নয়ন কাজ। আর এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সর্বশেষ শনিবার সিসিকের এমন ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়ন কাজের বলি হয়ে প্রাণ হারালেন এক সেনা সদস্য। এরআগে বিভিন্ন সময়ে সড়কের পাশে সিসিকের নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখায় দুর্ঘটনায় আহত হন সাংবাদিক, আলোকচিত্রীসহ অনেকে।
শনিবার দুপুরে নগরের বন্দরবাজার এলাকায় সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে স্টিলের পাইপ পড়ে মারা যান সেনাবাহিনীর ল্যান্স কর্পোরাল দেলোয়ার হোসেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সিলেট নগরভবনের ১২ তলার নির্মাণ কাজ চলছে। শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে ভবনের ১২ তলার ছাদ থেকে হঠাৎ করেই একটি স্টিলের পাইপ সিটি মার্কেটের ভিতরে ওই সেনা সদস্যের মাথায় এসে পড়ে। সাথে সাথে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাৎক্ষনিক ভাবে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ছাদ থেকে পড়া পাইপের আঘাতে আরো একজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ ঘটনার পর ফের আলোচনায় এসেছে সিসিকের অরক্ষিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিষয়টি। উন্নয়ন কাজের আগে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সিসিকের সমালোচনা করছেন অনেকে।
এ প্রসঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, প্রায় ২ বছর ধরে জামাল এন্ড কোং নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নগরভবনের নির্মাণকাজ করে আসছে। কিন্তু সবদিকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেও সিটি মার্কেটের দিকে কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ওইদিকেই দুর্ঘটনাটি ঘটে। ১২ তলা থেকে বিদ্যুতের লোহার খুঁটি সিটি মার্কেটের ছাদ হয়ে ওই সেনা সদস্যের ওপর পড়ে।
তিনি বলেন, ঘটনার পরপরই গাফিলতির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
২০২০ সালে কবি আব্দুল বাছিত মোহাম্মদ মৃত্যুর পর সিটি করপোরেশনের অরক্ষিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী গোলাম সোবহান চৌধুরী দীপন। রিটে কবি আব্দুল বাছিত মোহাম্মদের ‘মৃত্যু’র সুষ্ঠু তদন্ত ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট জেলা প্রশাসককে এই ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরে জেলা প্রশাসকের তদন্ত প্রতিবেদনেও সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কাজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করার বিষয়টি উঠে আসে।
এ প্রসঙ্গে আইনজীবী গোলাম সোবহান চৌধুরী দীপন শনিবার বলেন, যে কোন উন্নয়ন কাজের আগেই নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে হয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব কাজের ঠিকাদারদের। কিন্তু কোন ঠিকাদারই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেন না। এবং এটি তদারকি করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের থাকলেও তারা এগুলো এড়িয়ে যান। এরফলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে।
দীপন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণভাবে উন্নয়ন কাজের জন্য একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। আজকেও একজনের প্রাণ গেলো। সিটি করপোরেশন কোনভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না। এই ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
এদিকে শনিবারের ঘটনায় নগর ভবনের নির্মাণ কাজের সাথে সম্পৃক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ৯ সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ। এছাড়া সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- গণপূর্ত বিভাগ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী রিপন কুমার রায়, সিসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আলী আকবর, শিক্ষা ও প্রকৌশল অধিদপ্তর সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল হাকিম, সিসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান খান, সিসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) রুহুল আলম ও সিসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজি উদ্দিন খান।
তদন্ত কমিটি গঠনের তথ্য জানিয়ে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, এধরণের ঘটনায় আমি মর্মাহত। এ ঘটনায় ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তারা প্রতিবেদন জমা দিবেন। আমি সেনা কর্তৃপক্ষের সাথেও কথা বলেছি। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সিলেট কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী মাহমুদ বলেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই নির্মাণ কাজের জন্য নগরভবনের নির্মাণকাজে জড়িত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ৯ জনকে আটক করা হয়েছে। নিহতের মরদেহ ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।