নিজস্ব প্রতিবেদক | ০৫ জুন, ২০২৩
বিস্তীর্ণ হাওরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি কাঁচা সড়ক। এবড়ো-থেবড়ো, স্থানে স্থানে কাদাজল জমে আছে। পায়ে হেঁটে চলাচলেরও জো নেই। দেখে মনে হতে পারে কোন অজপাড়াগাঁয়ের সড়ক এটি। কিন্তু আদতে এই এলাকা সিলেট সিটি করপোরেশনের ভেতরে। সিটি করপোরেশনের ৪০ নং ওয়ার্ডের আলমপুর থেকে ছিটা গোটাটিকর গেছে সড়কটি।
ছিটা গোটাটিকর এলাকার বাসিন্দা, পল্লী চিকিৎসক কৃষ্ণমণি বিশ্বাস আক্ষেপ করে বলেন, প্রায় দুই বছর আগে আমাদের এলাকা সিটি করপোরেশনের আওতায় এসেছে। তার বহু আগে থেকেই একেবারে নগর লাগোয়া এলাকা এটি। কিন্তু এখানে কোন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি।
তিনি বলেন, এলাকার একমাত্র সড়কটি পাকা হয়নি এতদিনেও। সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কে কাদা জমে। আর বর্ষা মৌসুমে তো পানিতে তলিয়ে যায়। নৌকা ছাড়া তখন চলাচলের আর কোনো বিকল্প থাকে না। কে বলবে এটি নগরের একটি এলাকা, অজপড়াগাঁয়েও মনে হয় এখন এমন সড়ক নেই।
এই আক্ষেপ কেবল কৃষ্ণমনি বিশ্বাসের নয়, কিংবা এই চিত্র একটি পাড়া বা একটি সড়কের নয়। প্রায় একই একইরকম অবস্থা সিলেট সিটি করপোরেশনের নতুন ১৫ টি ওয়ার্ডের।
২৬ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার সিলেট সিটি করপোরেশনের আয়তন বাড়িয়ে ২০২১ সালে ১৭৯ বর্গকিলোমিটার হয়। এসময় নগরের ২৭ টি ওয়ার্ড বেড়ে ৪২ টিতে পরিণত হয়। নগর বর্ধিতকরণের প্রায় দুইবছর হতে চললেও এখন পর্যন্ত নতুন ১৫ টি ওয়ার্ডে লাগেনি কোন উন্নয়নের ছোঁয়া। সবধরনের নাগরিক সুবিধা থেকেই বঞ্চিত এসব এলাকার ভোটাররা। ফলে নামে নগর হলেও সিলেট সিটির নতুন ১৫ টি ওয়ার্ড এখনো যেন একেকটি গ্রাম।
নতুন ১৫ টি ওয়ার্ডে ৪টি আঞ্চলিক অফিস স্থাপন করলেও এখন পর্যন্ত এসব এলাকায় নেই সিটি করপোরেশনের কোন কার্যক্রম। তবে নগর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্ধিত ওয়ার্ডের উন্নয়নে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। এটি পাশ হলে এসব ওয়ার্ডের চেহারা বদলে যাবে।
এমন পরিস্থিতিতে দুয়ারে এসেছে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনে নতুন ওয়ার্ডগুলোর উন্নয়নে নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন মেয়র প্রার্থীরা। নতুন এই ওয়ার্ডগুলোর ভোটাররা এবারের নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন বলেও মনে করা হচ্ছে।
সরেজমিনে নতুন ১৫ টি ওয়ার্ডের অন্তত ৩০ টি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি পাড়ায়ই অপ্রশস্ত ও ভাঙাচোরা, কোথাওবা কাচা সড়ক সড়ক, অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকা এবং যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনার স্তূপ, সুপেয় পানীয় জলের অভাব, জলাবদ্ধতা, মশার উপদ্রব, সড়কবাতি না থাকা- এসব সমস্যা রয়েছে।
এসব সমস্যার কথা উল্লেখ করে ৩৫ নং ওয়ার্ডের বাহুবল এলাকার বাসিন্দা পার্থ চৌধুরী বলেন, আমরা সব ধরনের নাগরিকসুবিধা থেকেই বঞ্চিত। এখানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। ফলে বৃষ্টি হলেই সড়কে পানি জমে থাকে। তাছাড়া ময়লা আবর্জনা জমে থাকে। অনেকটা নগরের মোড়কে গ্রামে রয়েছি আমরা।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, সিলেট পৌরসভা থেকে ২০০১ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) গঠিত হয়। তখন ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয় সিটি করপোরেশনকে। ২০১৫ সালের ২৩ জুন নগরীর বর্তমান আকারের প্রায় ছয় গুণ আয়তন বাড়ানোর একটি প্রস্তাব স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। ২০২০ সালের ৯ আগস্ট সিসিকের আয়তন বাড়ানোর বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে জেলা প্রশাসন। ২০২১ সালের আগস্টে বর্ধিত এলাকাগুলোকে ওয়ার্ডে বিভক্ত করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এতে সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর ও টুলটিকর ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বরইকান্দি, কুচাই ও তেতলি ইউনিয়ন সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৩৩ নং ওয়ার্ডের খাদিমপাড়ার এলাকার বাসিন্দা আজমল হোসেন বলেন, আমরা কোন সুবিধা তো পাই না। উল্টো দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আগে জন্ম মৃত্যু সনদ আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পেতাম। কিন্তু গত দুবছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদ নেই আবার আমাদের ওয়ার্ডে কাউন্সিলরও নেই। ফলে কোন জন্মমৃত্যু সনদ দেয়া হচ্ছে না। জরুরী প্রয়োজনেও এসব কেউ তুলতে পারছে না।
এমন অবস্থায় সিটি নির্বাচনের প্রচারণায়ও উঠে এসেছে নতুন ওয়ার্ডগুলোর উন্নয়নের বিষয়টি। মেয়র প্রার্থীদের প্রায় সকলেই নতুন ওয়ার্ডেও ভোটারদের অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। সিসিকের ৪২টি ওয়ার্ডে এবার মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৬০৫ জন। এরমধ্যে নতুন ১৫টি ওয়ার্ডে ভোটার ভোটার রয়েছেন ১ লাখ ২৪ হাজার ৫২৯ জন।
সিলেটে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমি নির্বাচিত হলে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী প্রতিটি ওয়ার্ডে সুষম উন্নয়ন করবো। ওয়ার্ডভিত্তিক আলাদা উন্নয়ন পরিকল্পনা করবো। ফলে কোন ওয়ার্ডই উন্নয়ন বঞ্চিত থাকবে না।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল বলেন, আমি মেয়র নির্বাচিত হলে নতুন ওয়ার্ডগুলোর উন্নয়নে অধিক গুরুত্ব দেবো। কারণ এই ওয়ার্ডগুলো একেবারে অবহেলিতভাবে আছে।
নির্বাচিত হলে নতুন ১৫ ওয়ার্ডের জন্য আলাদা বরাদ্দের ব্যবস্থা করবেন জানিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, নতুন ওয়ার্ডগুলোর ভোটাররাই আমাকে সর্বাত্মক সমর্থন দিচ্ছেন।
সিলেটের বর্তমান মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী এবার নির্বাচনে প্রার্থী হননি। নতুন ১৫ ওয়ার্ডের উন্নয়ন না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নতুন ওয়ার্ডগুলোর জন্য আমরা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) প্রণয়ন করে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দেই। এটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়েও অনুমোদিত হয়েছে। এখন একনেকে উঠার অপেক্ষায় আছে। এই প্রকল্পটি পাস হলে বর্ধিত এলাকাগুলো আর উন্নয়নবঞ্চিত থাকবে না।