শাকিলা ববি

১০ নভেম্বর, ২০২৪ ২০:৩৮

সিলেটে আওয়ামী লীগ নেতার পত্রিকার মালিক এখন বিএনপি নেতা

৫ আগস্টের পর হয়েছে ক্ষমতার পালাবদল। দলীয় কোনো সরকার এখনো নির্বাচিত হয়নি। তারপরও দলীয় প্রভাব খাটানো শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জায়গা জমি পর্যন্ত দখল হচ্ছে। এমনকি মিডিয়া হাউসের মালিকানার হাত বদল হয়েছে।

সম্প্রতি সিলেটে একটি আঞ্চলিক পত্রিকার মালিকানা বদল নিয়ে চলছে তোলপাড়।

জানা গেছে, কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরওয়ার হোসেন সিলেটের আঞ্চলিক পত্রিকা ‘শুভ প্রতিদিন’-এর মালিক। ১৩তম বর্ষে পা রাখা এই পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশকও তিনি। পত্রিকার মালিক দেখিয়ে সরওয়ার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেলেও তিনি ‘দলীয় নির্দেশে’ সিলেট-৬ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন।

আওয়ামী সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হওয়ায় তিনি এখন আত্মগোপনে। এরপরই গুঞ্জন উঠেছিল এই পত্রিকার মালিকানা বদলের। এই গুঞ্জনের পালে হাওয়া লাগে যখন সিলেট মহানগর বিএনপির সদ্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদীর কার্যালয়ে ‘সম্পাদকীয় কার্যালয় শুভ প্রতিদিন’ লেখা সাইনবোর্ড সাঁটানোর পর।

সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও সিসিকের প্যানেল মেয়র ছিলেন সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। এই ওয়ার্ডের হাউজিং স্টেট এলাকায় তার কার্যালয়। সম্প্রতি সেই কার্যালয়ে পত্রিকার নামে উঠেছে নতুন সাইনবোর্ড। তাই অনেকেই বলছেন, ক্ষমতার দাপটে সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দখল করেছেন এই পত্রিকা। অনেকে আবার বলছেন মালিক সরওয়ার হোসেনে দল ক্ষমতায় নেই, তাই কয়েস লোদীকে সাময়িকভাবে চালাতে দিয়েছেন।

সরজমিনে দেখা যায়, কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সাইনবোর্ড খুলে ‘সম্পাদকীয় কার্যালয় শুভ প্রতিদিন’ সাইনবোর্ড লাগালেও এখনো পত্রিকা সংশ্লিষ্ট কোনো আসবাবপত্র বা অন্য কোনো সামগ্রী এখানে সাজানো হয়নি। কাউন্সিলরের কার্যালয় থাকা অবস্থায় ভিতরে যে সাজসজ্জা ছিল এখনো তাই আছে। পত্রিকাটির কার্যালয় নগরীর নেহার মার্কেটে রয়েছে।

প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মীদের মাধ্যমে জানা গেছে, কয়েস লোদী সরওয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে পত্রিকাটির সত্ত্ব নিজ নামে করে নিয়েছেন। বিদেশে অবস্থানরত প্রতিষ্ঠাকালীন একজন কর্মী বলেন, ‘পত্রিকাটি ডিএফপি তালিকাভুক্ত। সরকার বদলের সঙ্গে ডিএফপি তালিকাভুক্ত যাতে থাকে, এ জন্য মালিকানা বদল করা হয়েছে। এতে কোনো আর্থিক লেনদেন হয়নি।’

আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পত্রিকার মালিক বদলের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা সরওয়ার হোসেন একটি ডেন্টাল কলেজ ও একটি ওষুধ কোম্পানিরও পার্টনারশিপ মালিকানায় ছিলেন। ওই দুই প্রতিষ্ঠানের মালিকানাও কয়েস লোদী নিয়েছেন। এর বিনিময়ে তার ওপর মামলাসহ রাজনৈতিক দমনপীড়নে ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষ থেকে সহায়তার আশ্বাস পেয়েছেন।

সরওয়ার হোসেন আত্মগোপনে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরিবার ঘনিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছেন, তিনি কয়েস লোদীর কাছে মালিকানা দিয়েই কানাডা পাড়ি দিয়েছিলেন।

যোগাযোগ করলে বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান কয়েস লোদী কেবল পত্রিকার মালিকানা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে ওষুধ কোম্পানি ও ডেন্টাল কলেজের বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানি ও ডেন্টাল কলেজ সম্পর্কে আমি বলতে পারব না। এগুলোতে প্রায় ৫৬ থেকে ৬০ জনের শেয়ার আছে।’

পত্রিকার বিষয়ে রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘পত্রিকাটি আমি অনেকদিন আগে কিনেছি। তাই এই পত্রিকার মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এটা উনি আমার কাছে বিক্রি করেছেন, অফিসিয়াল নিয়মনীতি মেন্টেইন করে। জেলা প্রশাসকের কাছে ডকুমেন্ট সাবমিট করে তারপর সেটির মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে।’

কবে কিনেছেন পত্রিকা? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দিন তারিখ কাগজপত্র দেখে বলতে হবে। অনলাইনের জন্য ডকুমেন্ট সাবমিট করা হয়েছে ঢাকায়। এটা এখনো ট্রান্সফার হয়ে আসেনি।’

ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতার পত্রিকার মূল মালিক বনে যাওয়া ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অংশীদারির মালিকানা নেওয়ায় কয়েস লোদী বিতর্কের মুখ পড়েছেন। দলীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে গণমাধ্যমকর্মীরা এ বিষয়টি তলে তলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত হিসেবে দেখছেন। এরমধ্যে আঁতাত বিষয়টি ইঙ্গিত করেছেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক নুরুল হক শিপু।

তার ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস সূত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘পালাবদলে সিলেটে কতকিছুর হাতবদল হচ্ছে। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতার এক মিডিয়ার হাতবদলে তলে তলে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের এই পত্রিকাটির মালিকানা বদল হয়েছে ৫ আগষ্ট পরবর্তী বাস্তবতায়। এখন মালিক যিনি, তিনি সিলেট মহানগর বিএনপির সদ্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী।‘

ফেসবুক পোস্টটিতে আরও লেখা হয়, ‘আগের মালিক সরওয়ার হোসেন পলাতক। সরওয়ারের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ রেখে মিডিয়া হাউসটি লিখিয়ে নিয়েছেন বিএনপি নেতা কয়েস লোদী। পলাতক সরওয়ার কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর আছে কয়েস লোদীর কাছে! সিলেটে এভাবেই আওয়ামী লীগের প্রভাব হাইজ‍্যাক করে এখন বিএনপির হয়ে যাচ্ছে। এই দেশে কে বলে আওয়ামী লীগ নাই? তলে তলে সরওয়ার হয়ে কয়েস লোদীরাই টিকিয়ে রাখবে আওয়ামী লীগকে।...’

যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত সাংবাদিক নুরুল হক শিপু ফোনে বলেন, ‘কয়েস লোদী সম্প্রতি সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পদে আসীন হয়েছেন। যদি তিনি এ পদে না থাকতেন, তাহলে এ বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হতো না। এখন যেন ব্যাটে-বলে লেগে গেছে! বিষয়টি বিএনপি-আওয়ামী লীগে আঁতাতের উদাহরণ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে!’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত