Sylhet Today 24 PRINT

এখন কী অবস্থা সাদাপাথরের?

নিজস্ব প্রতিবেদক  |  ০৩ অক্টোবর, ২০২৫

ঢাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ‘সাদাপাথর’ এলাকায় ভ্রমণে এসেছেন। এর আগেও তিনি এই এলাকা ভ্রমণ করেছেন। তবে আগের মত ভালো লাগেনি তার।

তিনি বলছিলেন, “তিন বছর আগে এসেছিলাম সাদাপাথরে। পাথরগুলো এখন আর আগের মত নেই। এখানকার সেই সৌন্দর্যও আর নেই। এখন চারপাশে প্রচুর ভাঙা আর কাটা পাথর। হাঁটার সময় অসাবধান হলেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমার মনে হয় এগুলো সরানো দরকার।”

তবে প্রথম এই পর্যটনকেন্দ্রে এসে ভালো লেগেছে ময়মনসিংহের মো. তমাল শেখের। তিনি বলছিলেন, “অনেক সুন্দর জায়গা, গোলস করেছি পানিতে। আমার আবার আসার ইচ্ছে রয়েছে।”

৫ অগাস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ‘সাদাপাথরে’ ব্যাপক লুটপাট হয়। এ নিয়ে সারাদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পর্যটক কমে যায়।

পরে সরকার পাথর প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেয়। তার অংশ হিসেবে ‘ভাঙা আর কাটা’ পাথর ধলাই নদীতে ফেলার পর সেখানে পর্যটকদের ভিড় কিছুটা বেড়েছে। তবে ‘ভাঙা ও কাটা’ পাথর পর্যটকদের জন্য ‘ঝুঁকি’ তৈরি করছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

ভেসে উঠেছে ভাঙা-কাটা পাথর

‘সাদাপাথর’ নৌকাঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, পর্যটকরা নৌকা থেকে নেমে মূল স্পটের দিকে যাচ্ছেন। যাওয়ার পথে কেউ ছবি তুলেছেন, কেউবা বিভিন্ন দোকানের সামনের দাঁড়িয়ে পণ্য কেনার জন্য দরদাম করছেন। নৌকাঘাট থেকেই নেমেই পর্যটকরা মুখোমুখি হন ঘোড়া চালকদের। দরদাম করে পর্যটকদের অনেকে মূল স্পটে যাচ্ছেন ঘোড়ায় চড়ে ।

বালুচর পেরিয়ে পর্যটকরা পাথরের উপর দিয়ে সতর্ক হয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। ছোট-ছোট শিশুদের হাতে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন অভিভাবকরা। পানি কমে যাওয়ায় ভেসে উঠেছে পাথরগুলো। পর্যটকরা মূল স্পটে গিয়ে কেউবা স্বচ্ছ জলে নেমে পড়ছেন, কেউবা দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। জলে নেমে একজন অপরজনের উপর জল ছিটিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার জলের নিচে থাকা পাথরে বসে তাকিয়ে আছেন সারি-সারি পাহাড়ের দিকে।

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাথরগুলো যেখানে ফেলা হয়েছে সেখানে আগে পানি ছিল। এখন পানি কমে যাওয়ায় ভেসে উঠেছে পাথরগুলো। এর মধ্যে অনেক পাথর ভাঙা। এই পাথরগুলো দ্রুত সরানো দরকার, তা না হলে পানি বাড়লে পর্যটকরা আহত হবেন।

কোম্পানীগঞ্জ ফটোগ্রাফি সোসাইটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন সুমন বলেন, “ভাঙা পাথরগুলো পর্যটকদের জন্য খুব রিস্ক হয়ে যাচ্ছে। আমি প্রশাসনকে অনুরোধ করব, কাটা পাথরগুলো যেন ওইখানে প্রতিস্থাপন না করা হয়। আর প্রতিস্থাপন করা পাথরের মধ্যে থাকা কাটা পাথরগুলো সরানোর জন্য অনুরোধ করছি।”

বেড়েছে পর্যটক

‘সাদাপাথর’ যাওয়ার নৌকাঘাট এলাকায় আগের থেকে বেশি গাড়ি দেখা গেল। নৌকাঘাটেও বেড়েছে ব্যস্ততা। নৌকায় করে পর্যটকদের আনা-নেওয়ায় ব্যস্ত সময় পার করছেন মাঝিরা। ঘাট এলাকার রেস্টুরেন্ট ও বিভিন্ন পণ্যের দোকানগুলোতেও পর্যটকদের আনাগোনা চোখে পড়ল।

‘সাদাপাথর’ নৌকাঘাট এলাকার ব্যবসায়ী রেদওয়ান আহমেদ বলেন, “আগের থেকে পর্যটক বেড়েছে, তবে আমাদের বেচাকেনা বাড়েনি। আগের বছরগুলোতে এই সময়ে প্রচুর পর্যটক আসতেন, আমাদের বেচাকেনাও ভালো হত।”

‘সাদাপাথর’ মূল স্পট এলাকার দোকানি লীলু মিয়া বলেন, “আমাদের বেচাকেনা কিছু বেড়েছে। পাথর ফেলানোর এখন পর্যটকের চাপ আগের থেকে বেড়েছে। আশা করছি, আগামীতে পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে।”

ফটোগ্রাফর মো. রবিউল ইসলাম বলেন, “পর্যটক বেড়েছে সাত-আট দিন ধরে। পর্যটক বাড়লে আমাদের আয় রোজগারও বাড়ে। পর্যটক না এলে আমাদের ইনকাম বন্ধ থাকে।”

ঘোড়া চালক কালাম বলেন, “সাদাপাথরে মানুষ বেড়েছে। আশা করি সামনে আরও বাড়বে। পাথর আনার পর মানুষ আসছে। আমাদের আগের থেকে রোজগার বেড়েছে।”

পর্যটকবাহী নৌকা চালক জসীম মিয়া বলেন, “আজকে আমাদের সমিতির কোনো নৌকা তিনটি, কোনোটি দুটি করে ট্রিপ পেয়েছে। গত শুক্র ও শনিবার মিলে সমিতির ১৬০টির বেশি নৌকা ট্রিপ মারতে পেরেছে। পর্যটক বাড়লেও আগের মত আসতেছে না। সময় লাগবে আগের জায়গায় যেতে।”

‘বার বার বলা হলেও প্রশাসন কানে তোলেনি’

স্থানীয়রা বলছেন, মূলত পাথর যারা কিনেছিলেন, তারাই সাদাপাথারের এই অবস্থায় জন্য দায়ী। শুরুতে যদি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হত তাহলে এমন হত না। বিষয়টি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় অনেকে উপস্থাপন করেছিলেন। তারপরও আসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ২০ থেকে ৩০ জন ব্যক্তি এই পাথর কেনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

‘সাদাপাথর’ এলাকার পর্যটকবাহী নৌকার মাঝি, দোকানি ও ফটোগ্রাফাররা বলছেন, লুট হওয়া পাথর ‘অসাধু’ ব্যবসায়ীরা কিনে নেওয়ার পর দ্রুত সেগুলো ক্র্যাশার মিলে ভেঙে পরিবহন করা হত। তবে বড় পাথরগুরো হ্যামার দিয়ে ভাঙার পর মিলে আবার ভাঙা হত। মিল থেকেই অধিকাংশ পাথর উদ্ধার করা হয়েছে। পরে সেগুলো নদীর পাড়ে আনা হয়েছে।

তারা বলছেন, প্রশাসন চাইলে ভাঙা বা কাটা পাথর নদীর পাড় থেকে নৌকায় তোলার সময় আলাদা করতে পারত। তাহলে এত ভাঙা বা কাটা পাথর ‘সাদাপাথর’ এলাকায় থাকত না।

শিগগিরই ‘ভাঙা ও কাটা’ পাথর অপসারণ করা হবে জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম বলেন, “যে পাথরগুলো পুকুরে ফেলে রাখা হয়েছিল, সেখানে অর্ধেক ভাঙা পাথর ছিল। পানি এলে হয়ত ভাঙা পাথরগুলো এমনিতেই সরে যাবে। তবে এই ভাঙা পাথরগুলো আমরা ম্যানুয়ালি অপসারণ করব।”

তিনি বলেন, “পাথর প্রতিস্থাপন কাজ চলমান রয়েছে। পানি কমে যাওয়ায় নৌকায় পাথর নিয়ে গেলে আটকে যায়, তাই আমরা অপেক্ষা করছি পানি বাড়ার।”

নদীর পাড় আর মিলে জব্দ করা পাথর

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভেলাগঞ্জ এলাকার মিলগুলোর আশপাশে এখনও রয়েছে প্রশসানের অভিযানে জব্দ হওয়া পাথর। ওই এলাকার মিলগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় বন্ধ রয়েছে পাথর ভাঙার ক্র্যাশার মেশিন।

ধলাই নদীর ভোলাগঞ্জঘাট এলাকায় প্রশানের অভিযানে উদ্ধার হওয়া বিপুল পরিমাণ পাথরও পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এখান থেকেই পাথর ‘সাদাপাথর’ এলাকায় নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিন মিয়া বলেন, “পাথর প্রতিস্থাপন কাজ চলমান রয়েছে। প্রশাসন ৩০ লাখ ঘনফুট পাথর উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে ১৬ লাখ ঘনফুট পাথর প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। বাকিটা প্রতিস্থাপন করা হবে।”

৬ পর্যটনকেন্দ্র ঘিরে মহাপরিকল্পনা

কোম্পানীগঞ্জের ‘সাদাপাথর’ ও গোয়াইনঘাটের জাফলংসহ ছয়টি পর্যটনকেন্দ্রের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার।

কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশের পর্যটন শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, স্থানীয় অর্থনীতিতে গতি আনা এবং কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের লক্ষ্যেই এ মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

সিলেটের জাফলং, সাদাপাথর, বিছনাকান্দি, উৎমাছড়াসহ ছয়টি পর্যটনকেন্দ্রের পর্যটকদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা যেমন উন্নত সড়ক যোগাযোগ, পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সেবা, পরিচ্ছন্নতা এবং তথ্যসেবা কেন্দ্র গড়ে তোলার রূপরেখা রয়েছে মহাপরিকল্পনায়।

‘সিলেট পর্যটন মাস্টারপ্ল্যান কমিটি’র সদস্যরা গত সপ্তাহে বিভিন্ন পর্যটন এলাকা পরিদর্শন করেন। কমিটির সভাপতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বজলুর রশিদের নেতৃত্বে এ কমিটিতে পরিবেশ বিজ্ঞান, স্থাপত্য, নগর পরিকল্পনা, পর্যটন ব্যবস্থাপনা এবং সরকারি-বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন।

‘সাদাপাথর’ ঘুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন কমিটির সভাপতি বজলুর রশিদ। তিনি বলেন, “সরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন, পর্যটকদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ এবং স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাই মহাপরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। পরিকল্পনায় জলাভূমি, নদী, পাহাড় ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।”

পরিদর্শন দলের সঙ্গে থাকা সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম বলেন, “সৌন্দর্যে ঘেরা সিলেটকে আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সরকার মহাপরিকল্পনা নিয়েছে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র এলাকা ঘুরে দেখছেন। কমিটিতে চারটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা রয়েছেন।”

সূত্র: বিডিনিউজ

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
✉ sylhettoday24@gmail.com ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.