Sylhet Today 24 PRINT

প্রশাসনের যোগসাজশে হাকালুকির হাওরখাল বিলে মাছ লুটের মহোৎসব!

নামমাত্র খাস কালেকশন ১৭ দিনে ২ কোটি টাকার মাছ লুটের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট  |  ২৭ নভেম্বর, ২০২৫

ছবি: সংগৃহীত

এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরের সবচেয়ে বৃহৎ জলমহাল হাওরখালে গত প্রায় ১৭ দিন থেকে নামমাত্র খাস কালেকশনের নামে চলছে মাছ লুটের মহোৎসব। স্থানীয় সূত্রের তথ্যমতে গত ১৭ দিনে প্রায় ২ কোটি টাকার মাছ লুটপাট হয়েছে এ বিল থেকে। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা প্রশাসনের যোগসাজশে প্রভাবশালী কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এ লুটপাট করছেন বলে স্থানীয়ভাবে অভিযোগ উঠেছে।

বিষয়টি জানাজানি হলে মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে পুরো উপজেলা জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সচেতন মহল।

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রের ভাষ্যমতে, বিল দখল ও মাছ লুট নিয়ে মঙ্গলবার হারখাল বিলের পাড়ে ত্রিমুখি ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর জেরে যে কোনো সময় হাওরে সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে।

জানা গেছে, হাকালুকি হাওরের প্রায় ২ হাজার একরের সর্ববৃহৎ গোটাউরা হাওরখাল গ্রুপ (বদ্দ) জলমহালটি ১৪৩১ বাংলা সনের ৩০ চৈত্র পূর্ববর্তী ইজারাদার মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি উন্নয়ন প্রকল্পে তিন বছরের জন্য প্রায় ৫ কোটি টাকায় লীজ নিয়ে ফিসিং সম্পন্ন করে। পরবর্তী তিন বছরের জন্য প্রায় ৬ কোটি টাকায় আরেকটি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি জলমহালটির ইজারা পায়। ওই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে লীজ প্রদানের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। আর এই পরবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি প্রভাবশালী মহল সোনার বাংলা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে দিয়ে ১৪৩২-৩৪ বাংলা সনের লীজের উপর মহামান্য হাইকোর্টে রীট পিটিশন (নং-১৫৬৬৪/২০২৪) দায়ের করায়। আর এই রীট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট লীজের উপর স্থগিতাদেশ দেন। পরবর্তীতে জলমহালটি খাসকালেকশনে চলে যায়।

এতে সুযোগ পেয়ে যান বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতা। শুরুতেই স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রভাবে খুটাউরা হাওরখাল বিলে অ-মৎস্যজীবীদের নিয়ে কমিটি গঠন করে দেয় উপজেলা প্রশাসন। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট তালিমপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে মৎস্যজীবী প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি গঠনের কথা থাকলেও তা উপেক্ষা করে বড়লেখা-জুড়ী উপজেলার প্রভাবশালী অ-মৎস্যজীবীদের দিয়ে গত অক্টোবর (২০২৫) মাসে কমিটি গঠন করা হয়।

বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় ভুক্তভোগী অর্ধশতাধিক প্রকৃত মৎস্যজীবী সম্প্রতি বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। এ আবেদনের অনুলিপি বিভাগীয় কমিশনার, সিলেট; জেলা প্রশাসক, মৌলভীবাজার; এর কাছে দেওয়া হয়েছিল। বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গালিব চৌধুরী অভিযোগটি তদন্তের জন্য সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও তহসিলদারকে নির্দেশ দিলেও তদন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি।

এদিকে স্থানীয় প্রকৃত মৎস্যজীবীদের অভিযোগ উপেক্ষা করে উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে খাস কালেকশনের প্রস্তুতি নেন হাকালুকি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার। এতে হাকালুকি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার, ভূমি অফিস ও উপজেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী শীর্ষ নেতারা বিলের পাড়ে বাসা বানিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার মাছ লুট করে প্রকাশ্যে বিক্রি করেন। আর তহশিলদারকে নামমাত্র রাজস্ব প্রদান করেন। গত ১৭ দিনে মাছ লুটেরা প্রভাবশালীরা অন্তত ১ কোটি টাকার মাছ লুট সরকারি কোষাগারে ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকা জমা করেছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

অপরদিকে দিনে রাতে মাছ লুটের ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে কয়েকশ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে হাওরখাল বিলে জড়ো হন। এসময় লুটপাটকারী চক্রের সাথে ত্রি-মুখি ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সূত্র আরও জানিয়েছে, মাছ লুটের ভাগবাটোয়ারাটি পৌর শহরে বিএনপির এক শীর্ষ নেতার বাসায় হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বড়লেখা উপজেলা বিএনপির এক নেতা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘‘লুটপাটের এ ঘটনার সাথে বড়লেখা উপজেলার বর্তমান এক ইউপি চেয়ারম্যান, সাবেক এক ইউপি চেয়ারম্যান, জুড়ী উপজেলার বাসিন্দা একজন সংসদ সদস্য প্রার্থী সহ বেশ কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা জড়িত আছেন। মূলত স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে ওই নেতারা এ ঘটনা করার সাহস পেয়েছেন বলে জানা বিএনপির এ নেতা।’’ বিএনপির ওই নেতার বক্তব্যের রেকর্ড সাংবাদিকদের কাছে সংরিক্ষিত আছে।

এ ব্যাপারে বড়লেখা পৌর বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘‘হাকালুকি হাওরের হাওরখাল বিলের মাছ হরিলুটের খবর পেয়ে আমিও ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। সেখানে তহশিলদারকে দেখতে পাইনি। এসময় ৩৫টি নৌকা বোঝাই অন্তত ১০ লাখ টাকার মাছ বিক্রির জন্য অপেক্ষমাণ থাকতে দেখেছি।’’

স্থানীয় লোকজন বলেন, গত ১৭ দিনে অন্তত ২ কোটি টাকার মাছ লুট হলেও সরকার কতটাকা রাজস্ব পেয়েছে তা কেউ জানেন না। এভাবে সরকারি জলমহাল লুট হতে পারে না। প্রশাসন কি এদের কাছে জিম্মি হয়ে গেল?

গত ১৭ দিনে খাস কালেকশনে কত টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাঈমা নাদিয়া ও খাসকালেকশনের দায়িত্বে থাকা হাকালুকি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার ইউসুফ জাবেরের সাথে বারবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা কেউই ফোন রিসিভ না করায় এ সংক্রান্তে তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।

বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গালিব চৌধুরী জানান, বিষয়টি জেলা প্রশাসক স্যারের নজরে গিয়েছে। স্যারের নির্দেশনা মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সহকারি কমিশনার (ভূমি) -কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
✉ sylhettoday24@gmail.com ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.