Sylhet Today 24 PRINT

পরম্পরা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় চা শ্রমিকরা

সিলেটটুডে ডেস্ক |  ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

চা বাগান এখন আর টানছে না মিন্টু বাউরিকে। বাড়তি মজুরির আশায় বংশপরম্পরার পেশা ছেড়ে কিছুদিন ধরে কাজ করছেন ইটখোলায়। মজুরি পাচ্ছেন দৈনিক ৪০০ টাকা। নতুন প্রজন্মের কাউকেই আর চা শ্রমিকের পেশায় দেখতে চান না মৌলভীবাজারের মিন্টু বাউরি। নিজের সাত বছর বয়সী ছেলের পড়াশোনার দিকেই এখন তাই সব মনোযোগ।

চট্টগ্রামের কোদালা চা বাগানে শ্রমিক পরিবারের সন্তান বিটন বাউরি। পার্শ্ববর্তী শিলক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে চাইছেন পোশাক শিল্প অথবা অন্য কোথাও থিতু হতে। বিটনের চাচা হারাধন বাউরি চট্টগ্রামের একটি পোশাক কারখানার সুপারভাইজর। তার মাধ্যমে পেশা পাল্টাতে চাইছেন আরো কয়েকজন।

কোদালা বাগানেরই স্থায়ী বাসিন্দা পূর্ণিমা দে। পরিবারের অন্য নারীদের মতো এক সময় চা পাতা চয়নের কাজ করতেন তিনিও। স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর কর্ম খুঁজে নিয়েছেন কালুরঘাট এলাকার একটি পোশাক কারখানায়।

চা বাগানে মজুরি অত্যধিক কম হওয়ায় পূর্বপুরুষের পেশায় এখন আর থাকতে চাইছেন না মিন্টু বাউরি, বিটন বাউরি, পূর্ণিমারা। তাদের মতো আরো অনেকেই ভিন্ন পেশায় ঝুঁকে পড়ায় শ্রমিক সংকটে পড়তে হচ্ছে চা বাগানগুলোকে। ফলে সঠিক সময়ে চা পাতা সংগ্রহে অনেক সময় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বাগান কর্তৃপক্ষকে।

কোদালা চা বাগান কর্তৃপক্ষ বলছে, বাগানটিতে কর্মরত ৭০০ শ্রমিকের মধ্যে নিবন্ধিত ৫৭৪ জন। বাগানে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রমিক পরিবারের শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ২১৫ জন। প্রাথমিকের পাঠ শেষে মাধ্যমিকে ভর্তি হচ্ছে অনেকে। চা শ্রমিক পরিবারের মাধ্যমিক উত্তীর্ণ সন্তানদের ৮০ শতাংশই আর এ পেশায় যুক্ত হয় না।

কোদালা চা বাগানের ম্যানেজার মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, চা শ্রমিকদের সন্তানরাও বংশপরম্পরায় বাগানেই কাজ করে। তবে বর্তমানে অতি মজুরির আশায় নির্মাণ, কলকারখানা, পোশাক ও অন্যান্য খাতে চলে যাচ্ছে তারা। কেউ কেউ বিদেশেও পাড়ি জমাচ্ছে। বাগানে নিয়মিত কাজ করার কথা থাকলেও তাদের আটকে রাখা যাচ্ছে না। এ কারণে বছর বছর বাগান সম্প্রসারণ বাধ্যতামূলক হলেও শ্রমিকের অভাবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চা উৎপাদনে বেগ পেতে হচ্ছে।

চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে একজন চা শ্রমিক মজুরি পান ৮৫ টাকা। নিবন্ধিত হলে প্রতি সপ্তাহে ২ টাকা দরে ৩ কেজি ৩২০ গ্রাম আটা দেয়া হয়। আনুষঙ্গিক সুবিধা হিসেবে পান স্কুল, চিকিৎসা, সুপেয় পানি, বাসস্থান, চাষের জমি ও বার্ষিক বোনাস। শ্রমিক চাইলে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারে। শুধু চা পাতা প্লাকিং বা চয়ন শ্রমিকরা নির্ধারিত ২৩ কেজির অতিরিক্ত চা পাতা সংগ্রহ করলে বাগানভেদে অতিরিক্ত মজুরি পান।

স্বাভাবিক জীবনধারণের জন্য এ সুবিধাকে পর্যাপ্ত মনে করেন না শ্রীমঙ্গলে ফিনলে’র মালিকানাধীন বারাউড়া চা বাগানের একসময়ের শ্রমিক রিতেশ মোদী। বাগানে নিবন্ধিত শ্রমিক হলেও তিন বছর ধরে তিনি শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কে অটোরিকশা চালান। রিতেশ বলেন, বাগানে সারা দিন পাতা তুলে মজুরি মেলে ৮৫ টাকা। এ টাকায় সংসার চলে না। তাই অটোরিকশা চালাই। এখন রোজগার দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকা।

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার শ্রীপুর চা বাগানের পাশেই জাফলং পাথর কোয়ারি। সেখানে পাথর উত্তোলনের কাজ করেন শ্রীপুর বাগানের শ্রমিক কমল মাহালি। কম মজুরির কারণে বাগানের স্থায়ী শ্রমিক হওয়ার ইচ্ছা নেই তার। চা শ্রমিকের পেশা এখনো ধরে রাখলেও তা মুখ্য নয়। মজুরি বেশি পাওয়ায় পাথর শ্রমিকের কাজই তার বেশি পছন্দের।

চা বাগানে শ্রমিকের বাইরে অন্য কোনো কাজের সুযোগ না পাওয়ায় ক্ষোভ নিয়েই বংশপরম্পরার পেশা ছেড়েছেন সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিক অবিনাশ। এসএসসি পাস করা অবিনাশ এখন কাজ করছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এমএলএসএস হিসেবে। অবিনাশ বলেন, বাগানে শ্রমিকদের মধ্যে যারা লেখাপড়া শেখেন, তাদেরও শ্রমিক হিসেবেই কাজ করতে হয়। উচ্চপদে নিতে চায় না বাগান কর্তৃপক্ষ। ফলে যারা লেখাপড়া শিখছেন, তারা আর বাগানে কাজ করছেন না। যেমনটা আমিও করিনি।

চা শ্রমিকদের জন্য এখন বিভিন্ন ধরনের কাজের সুযোগ তৈরি হওয়ায় তারা এ পেশায় আর থাকতে চাইছেন না বলে জানান সিলেটে ডানকান ব্রাদার্সের ইটা চা বাগানের ম্যানেজার মো. ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, চা শিল্পের পুরুষ শ্রমিকরা নির্মাণ, ইটভাটা ও পরিবহন খাতে বেশি আগ্রহী। একসময় বাগান ছিল প্রত্যন্ত এলাকায়। বর্তমানে অধিকাংশ বাগানের কাছাকাছি বসতি, কলকারখানা, বাজার হয়েছে। এর ফলে চা শ্রমিকরা আদি পেশা ছেড়ে তুলনামূলক বেশি মজুরির কাজে যাচ্ছেন। এভাবে চললে কিছুদিনের মধ্যে চা খাতে শ্রমিক সংকট চরম আকার ধারণ করবে। এজন্য বিকল্প বাগান ব্যবস্থাপনায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

চা-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চা পাতা উত্তোলনের ভরা মৌসুম। এ সময় প্রতি সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে চা পাতা চয়ন করতে হয়। ২০ থেকে ২৫ শতাংশ শ্রমিক বাইরে কাজ করায় এ সময়টায় শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। বাধ্য হয়ে অস্থায়ী শ্রমিক দিয়ে চা পাতা প্লাকিংয়ের ফলে উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি নিম্নমানের চা তৈরি হয় বাগানগুলোয়। চায়ের উৎপাদনও এতে কমে যায়।

বারাউড়া চা বাগানের উপব্যবস্থাপক জব্বার আহমেদ সেবুল বলেন, প্রতি বছর উৎপাদন মৌসুমে ২০-২৫ শতাংশ শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাগান থেকে আমরা শ্রমিক নিয়ে আসি। এতেও সংকট পুরোপুরি মেটে না। বছরে ১০-১৫ শতাংশ উৎপাদন কম হয়। এ কারণে আমরা শ্রমিকনির্ভরতা কমিয়ে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াচ্ছি।

একই কথা বলেন সিলেটের গোয়াইনঘাটের শ্রীপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক মনসুর আহমদও। তিনি বলেন, আমাদের বাগানের অর্ধেক শ্রমিকই বাইরে কাজ করেন। ফলে যথাসময়ে উৎপাদন শুরু করা যায় না। এতে উৎপাদন কমার পাশাপাশি মানও কমছে।

চা বোর্ডের তথ্যানুসারে, দেশের ১৬৪টি চা বাগানে মোট আবাদি জমি ১ লাখ ৪৬ হাজার ২০৭ একর। এসব বাগানে নিবন্ধিত শ্রমিক রয়েছেন ১ লাখ ৩৩ হাজার। এর বাইরে অনিবন্ধিত শ্রমিক রয়েছেন প্রায় দেড় লাখ।

চাহিদা অনুযায়ী, চা শ্রমিকের এ সংখ্যাকে পর্যাপ্ত বলে মনে করেন চা বোর্ডের উপপরিচালক (পরিকল্পনা) মো. মুনির আহমেদ। তিনি বলেন, দেশে চা বাগানের পরিধি ও চা আবাদের পরিমাণ অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিবন্ধিত শ্রমিক রয়েছেন। সব বাগানে শ্রমিক সংকটের বিষয়টি সঠিক নয়। তবে বাগানভেদে এর ভিন্নতা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে অস্থায়ী শ্রমিক দিয়ে বাগানমালিকরা কাজ করিয়ে নেন।

সূত্র: বণিক বার্তা

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.