Sylhet Today 24 PRINT

আজ বালাগঞ্জের আদিত্যপুর গণহত্যা দিবস

উজ্জ্বল ধর |  ১৪ জুন, ২০১৫

১৪ই জুন ভোরে এক সাথে ৩টি পাক সাঁজোয়া যান প্রবেশ করে বালাগঞ্জের আদিত্যপুর। পাকবাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে রিফাতপুর, আদিত্যপুর, সত্যপুর, নারায়নপুর গ্রামে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে পড়া মহিলারা সতিত্ব রক্ষার্থে দিক-বেদিক ছুটাছুটি শুরু করলেন। বালাগঞ্জ থানা রাজাকার কমাণ্ডার আব্দুল আহাদ চৌধুরী (ছাদ মিয়া), লতিবপুরের লাল মোল্লা, মসরু মিয়াসহ ৫/৭জন দালাল দুজন পাক সেনাসহ এলাকার প্রতিটা ঘরে গিয়ে পুরুষদের খুঁজতে থাকে। তারা জানায়, ভয়ের কিছু নেই। এলাকার আইন শৃংখলা বজায় রাখতে সবাইকে নিয়ে আদিত্যপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হবে। শান্তি কার্ড দেওয়া হবে। এলাকায় কোন অরাজকতা ঘটলে পাকবাহিনী কার্ডধারীদের সহায়তা দেবে। তারপরও তাদের কথায় আস্থা রাখতে পারেনি সাধারণ মানুষ। কেউ লুকিয়ে পড়লো খাটের নীচে কেউ বা বাড়ির পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে। মহিলা ও শিশু-কিশোররা আশ্রয় নিলো গ্রামের পেছনের হাওরে।

রাজাকাররা প্রায় ৫ঘণ্টা রিফাতপুর, আদিত্যপুর, সত্যপুর, নারায়নপুর গ্রাম তছনছ করে পুরুষদের ধরে এনে আদিত্যপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জড়ো করে। শান্তি কমিটি গঠনকে প্রহসনে পরিণত করে ৬৫ জন পুরুষকে রশি দিয়ে বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। বাঁচাও বাচাঁও আর্তনাদে প্রকম্পিত হয়ে উঠে চারদিক। মুহূর্তেই শহীদ হন ৬৩জন। শরীরে গুলি নিয়েও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান শিব প্রসাদ সেন ও সুকময় বাবু।

সেদিনের ঘটনায় শহীদরা হলেন ১। শ্রীষ চন্দ্র সেন চৌধুরী, ২। সুভাষ সেন চৌধুরী, ৩। রাধিকা রঞ্জন পুরকায়স্থ, ৪। ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেব, ৫। বিপুল চন্দ্র দেব, ৬। সুধারাম দেব, ৭। দক্ষিণা রঞ্জন দেব, ৮। দীনেশ চন্দ্র দেব, ৯। মতি লাল দেব, ১০। শৈলেন্দ্র দেব, ১১। সুধন চন্দ্র দাশ, ১২। দিনেন্দ্র চন্দ, ১৩। কৃষ্ণ চন্দ, ১৪। যতিন্দ্র কুমার দাশ, ১৫। অতুল আচার্য্য, ১৬। নরেশ চন্দ্র দাশ, ১৭। বেহার রাম নমসূদ্র, ১৮। ঈশান রাম নমসূদ্র, ১৯। নারায়ন রাম নমসূদ্র, ২০। মাহিন্দ্র রাম নমসূদ্র, ২১। প্রভাত রাম নমসূদ্র, ২২। বলাই রাম নমসূদ্র, ২৩। ধনাই রাম নমসূদ্র, ২৪। বসন্ত রাম নমসূদ্র, ২৫। বনই রাম নমসূদ্র, ২৬। যতীন্দ্র দত্ত পুরকায়স্থ, ২৭। পরেশ চন্দ্র দত্ত, ২৮। সুনীম রাম শুক্ল বৈদ্য, ২৯। অভয় শব্দ কর, ৩০। সতীশ চন্দ দাশ গুপ্ত, ৩১। রাকেশ শব্দ কর, ৩২। ননী দেব, ৩৩। অমরা দেব, ৩৪। পরেশ শব্দকর, ৩৫। কুলেন্দ্র শব্দকর, ৩৬। পরেশ শব্দকর, ৩৭। নন্দ শব্দকর, ৩৮। দীগেন্দ্র দেব, ৩৯। মতীন্দ্র মোহন দাম, ৪০। সুকেন্দ্র সেন, ৪১। হৃদয় শুক্লবৈদ্য, ৪২। দীগেন্দ্র চন্দ্র শীল, ৪৩। সুরেশ শুক্লবৈদ্য, ৪৪। সুধন্য দাশ মধুসুদন, ৪৫। সুরিরাম শুক্লবৈদ্য, ৪৬। রাকেশ শব্দকর, ৪৭। অমর দেব, ৪৮। দীনেশ দেব, ৪৯। নারদ ধর, ৫০। দিগেন দেব, ৫১। চরকী দাশ, ৫২। দিনেশ দেব, ৫৩। খোকা দেব, ৫৪। ননী দেব, ৫৫। কলিন শব্দকর, ৫৬। সতীশ দেব, ৫৭। মতি দেব। শহীদ অন্য চারজনের নাম-পরিচয় আজো জানা যায়নি।

প্রতিটা পরিবারের পুরুষ যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন সে সময় রাজাকার ও পাকবাহিনীর হাত থেকে সম্ভ্রম বাঁচাতে গ্রামের মহিলারা পালানোর সুযোগ খুঁজছে। তবু এ দেশীয় হায়নার কবলে সতিত্ব বিসর্জন দেয় প্রায় ২০মহিলা। প্রায় ৭ঘণ্টা তান্ডব চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা প্রতিটা বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ চালায়।  ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পূর্বে সেখান থেকে এক ষোড়শীকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকার আব্দুল আহাদ চৌধুরী (ছাদ মিয়া)। প্রায় এক সপ্তাহ মেয়েটিকে ছাদ মিয়া তার বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করে।

এতো বড় অঘটনের পর আবারো নির্যাতনের ভয়ে কেউ থাকলো না আদিত্যপুর ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামে। অন্যদিকে লাশের পঁচা গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা। ১৭ই জুন বৃহস্পতিবার রাজাকাররা আবার এলো আদিত্যপুরে। এবার লুণ্ঠন বা হত্যা নয়। সংবাদ মিডিয়া থেকে আড়াল করতে কোনোরকম ধর্মীয় আচার ছাড়াই লাশগুলো এবার মাটিচাপা দিল তারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানীর উপস্থিতিতে মাটি খুঁড়ে লাশ বের করা হয়। তারপর পোস্টমর্টেমের জন্য প্রেরণ করা হয় সিলেট সদর হাসপাতালে। সেখানে দেশি ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের সামনে লাশের সংখ্যা গণনা করা হয়। তারপর লাশগুলো আবার আদিত্যপুর এনে বর্তমান গণকবরে সমাহিত করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের বেশ কবছর পর সদ্য প্রয়াত শিবপ্রসাদ সেন চৌধুরী (পাকিস্তানিদের বুলেট বিদ্ধ হয়ে বেঁচে যাওয়া একজন) আদিত্যপুর গণকবরের সীমানা নির্ধারনে দেয়াল তৈরির কাজে হাত দেন। ইট, বালু ইত্যাদি ক্রয় করার পর জমির মালিক বাঁধা দেয়। ফলে তার এ উদ্যোগের মৃত্যু। ১৯৮৪ সালের ৩০এপ্রিল বালাগঞ্জ থানা পরিষদের এক সভায় আদিত্যপুর গণকবর নামে ২৪হাজার ৮৩২টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। চারিদিকে দেয়াল দিয়ে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেখানে ৩লাখ টাকা ব্যয়ে একটি স্মৃতিস্বম্ভ নির্মাণ করে শহীদদের নাম ফলক বসানো হয়। তবে স্মৃতিস্বম্ভে খচিত শহীদদের অনেকের নাম নিয়ে অনেকেরই অভিযোগ রয়েছে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.