রিপন দে, মৌলভীবাজার | ২০ জুন, ২০১৮
আকস্মিক বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়া মৌলভীবাজারে ৩ ইউনিয়নের ৩ লাখ মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে পড়েছেন। এজন্যে দায়ী করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদাসীনতা আর অব্যবস্থাপনাকে।
উজানের ঢল আর টানা বৃষ্টির কারণে এ মাসের ১৩ তারিখ থেকে মৌলভীবাজারের ধলাই নদীর করিমপুর এলাকায় বাধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে, এর পর ধলাই নদী ও মনু নদের ২৫টি ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ করে জেলার প্রায় ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ডুবে যায় টিউবওয়েল এবং কাচা-পাকা ল্যাট্রিন। বন্যার পানি আর ল্যাট্রিনের ময়লা এক হয়ে মারাত্মক দূষণের শিকার হয়েছে। এতে বিশুদ্ধ পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে বন্যা কবলিত এলাকায়।
পানিবন্দি অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে গেলেও বেশিরভাগ মানুষ নিজের শেষ সম্বল পাহারা দিতে থেকে যান নিজ ভিটায়। বিশুদ্ধ জলের অভাবে তারা বাধ্য হয়ে পান করেন বানের জলের পানি।
অঞ্চল ভেদে বন্যা ৪ থেকে ৬ দিন অতিক্রম করলেও অনেক জায়গায় প্রতিনিধি পর্যায়েই পৌঁছায়নি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট।
কুলাউড়া উপজেলার শরিফপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জোনাব আলী জানান, ৬ দিন যাবত অন্তত ৪০ টি গ্রাম পানিবন্দি কিন্তু এখন পর্যন্ত পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পাইনি।
জেলা প্রশাসনের হিসেব মতে, জেলায় ৪০ হাজারের উপরে পরিবার পানিবন্দি থাকলেও জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী জানিয়েছেন মাত্র ৮০৬ টি টিউবওয়েল বন্যার কবলে পড়েছে।
কিন্তু সরেজমিনে এর মিল পাওয়া যায়নি বাস্তবতায় তা কয়েকগুণ। ৪০ হাজার পরিবারের বিপরিতে হিসেব করলে এবং বিভিন্ন ইউনিয়নভিত্তিক দুর্গত গ্রামের হিসেবে তা ৫ হাজারের উপরে। জেলার ক্ষতিগ্রস্ত স্যানিটেশন নিয়েও কোন সঠিক হিসেব নেই এই কর্মকর্তার কাছে।
সোমবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মৌলভীবাজার সফরে গিয়ে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর কাছে জানতে চান পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণের তথ্য; জবাবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী জানান, ১০ হাজার বিতরণ করেছেন নিজেরা, সিভিল সার্জনকে দিয়েছেন ১০ হাজার, এছাড়া মজুত আছে আরও ৬ হাজার।
সরকারি তথ্যমতে, জেলায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি আর এত মানুষের জন্য মাত্র ১০ হাজার আর মজুতে মাত্র ৬ হাজার জেনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মন্ত্রী। এতে বেরিয়ে আসে কর্মকর্তাদের অবহেলা। আগাম বন্যার আভাস ছিল এবং বন্যার ৪ দিন পরেও সরকারের কাছে কোন চাহিদাপত্র দেওয়া হয়নি বলে জানা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মন্ত্রীর সফরের আগে জেলার কোথাও বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিলি করা হয়নি। মন্ত্রীর সফরে সংবাদে জেলায় আরও ১ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেওয়া হয়।
কমলগঞ্জের পতনউষা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তৌফিক আহমেদ বাচ্চু জানান, আমি মন্ত্রীর সফরের পর ২ হাজার বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পেয়েছি। শুনেছি মন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন দ্রুত পৌছাতে।
একই তথ্য জানান সদর উপজেলার মনুরমুখ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল হক শেফুল। তিনি বলেন এত দিন পাইনি আজ পেয়েছি।
তবে ইউনিয়ন পর্যায়ে গেলেও এখনো পানি বিশুদ্ধকরণ পৌঁছায় নি পানিবন্দি মানুষের হাতে।
রাজনগরের প্রেমনগর গ্রামের দুলু মিয়া জানান, পানি না খেলে বাঁচব কেমনে? বিশুদ্ধ পানির অভাবে বাধ্য হয়ে বন্যার পানি খাচ্ছি।
এদিকে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশুদ্ধ পানি পান না করায় মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে পানিবাহিত রোগের। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সাঈদ এনাম জানান, বন্যার পানি পান করলে ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ৩০ মিনিট ফুটিয়ে খেতে হয়, তবে পানিবন্দি মানুষের সে সুযোগ না থাকায় দূষিত পানির কারণে ডায়রিয়া, আমাশয় সহ নানা রোগ হতে পারে।
এরই মধ্যে পানিবাহিত রোগের খবর পাওয়া গেছে বন্যা কবলিত এলাকায়। পতনউষা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জানান, তার ইউনিয়নে ৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী সোহরাব উদ্দিন আহমদ জানান, আমি ১৭ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করেছি বিভিন্ন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও সেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে। ত্রাণমন্ত্রীর সফরের পর আজ আরও ১ লাখ নতুন এসেছে যা মজুত আছে।
মানুষের হাতে কেনো পৌঁছায়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি খোঁজ নিচ্ছি।
জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম জানান, বাড়ি-বাড়ি গিয়ে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ, স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য সব ধরনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।