Sylhet Today 24 PRINT

সিলেটে চা-বাগানের ২০০ কোটি টাকার ভূমি জালিয়াতি করে নামজারি

লাক্কাতুরা চা বাগান

সিলেটটুডে ডেস্ক |  ১৫ মার্চ, ২০১৯

জালিয়াতি করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের চা-বাগানের ভূমি নামজারির পর দখলচেষ্টার একটি ঘটনা ধরা পড়েছে সিলেটে। সরকারি বিনিয়োগে পরিচালিত ন্যাশনাল টি কোম্পানির লাক্কাতুরা চা-বাগানের প্রায় ২৬ একর জায়গা ব্যক্তির নামে নামজারি হয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের জালিয়াতি করা একটি স্মারকে। সম্প্রতি এ বিষয়টি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসন নামজারি বাতিল করেছে। কিন্তু নামজারির পেছনে থাকা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় সংঘবদ্ধ ভূমিখেকো চক্রটি অধরা রয়েছে। এতে বাগান কর্তৃপক্ষ ভূমির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন।

জেলা প্রশাসনের ভূমিসংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্র জানায়, একই রকম জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছিল সিলেটের তারাপুর চা-বাগানে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক জালিয়াতি করে ১৯৯০ সালে দেবোত্তর সম্পত্তির চা-বাগানের ৪২২ একর জায়গা ভুয়া সেবায়েতের মাধ্যমে দখলে নিয়েছিলেন রাগীব আলী। প্রায় দেড় যুগ পর ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের নির্দেশনায় তারাপুর চা-বাগান নিয়ে পৃথক দুটি মামলার পুনঃ তদন্তের পর সিলেটের মুখ্য মহানগর বিচারিক হাকিম আদালতে বিচার সম্পন্ন হয়। ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আদালত ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক জালিয়াতির দায়ে রাগীব আলীসহ অভিযুক্ত পাঁচজনকে ১৪ বছর করে কারাদণ্ড এবং সরকারের এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অপর মামলার রায়ে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন। তারাপুর চা-বাগানের কর্তৃত্ব ২৬ বছর পর দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েতকে বুঝিয়ে দেয় সিলেটের জেলা প্রশাসন।

সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম স্মারক জালিয়াতি করে নামজারি করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।  তিনি জানিয়েছেন, বিষয়টি ধরা পড়লে ১৯ ফেব্রুয়ারি আরেকটি আদেশে বাতিল করা হয়েছে নামজারি। এ বিষয়ে ন্যাশনাল টি কোম্পানির পক্ষ থেকে চিঠি পাওয়ার পর জেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভুয়া স্মারকে নামজারি হওয়ার পর ন্যাশনাল টি কোম্পানি নামজারি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বরাবর আপিল করেছিল। এ নিয়ে উচ্চ আদালত থেকে একটি স্থগিতাদেশও ছিল। ১৯ ফেব্রুয়ারি এই স্থগিতাদেশের ওপর স্থগিতাদেশ জারি হওয়ায় পূর্বের নামজারি বাতিল করে ওই ভূমি ফের ন্যাশনাল টি কোম্পানির নামে ফেরত দেওয়া হয়েছে।’

ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেড (এনটিসি) চা-বাগানে সরকারি বিনিয়োগের একমাত্র কোম্পানি। সিলেট শহরতলির লাক্কাতুরা চা-বাগানসহ সিলেট ও মৌলভীবাজারে চারটি চা-বাগান রয়েছে। এর মধ্যে লাক্কাতুরা সবচেয়ে পুরোনো বাগান। ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ মালিকানাধীন ৩ হাজার ১৭৪ একর চা-ভূমি পুরোটা দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্তের। এর মধ্যে ২৬ দশমিক ১৩ একর ভূমি গোপনে নামজারি সম্পন্ন হয় ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। শামছুজ্জামান চৌধুরীর নামে তৎকালীন সিলেট সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি) নামজারি সম্পন্ন করেন।

গত বছরের অক্টোবরে প্রভাবশালী ভূমি ব্যবসায়ীদের নামে জায়গা দখলচেষ্টায় নামেন ওই চক্রের পক্ষে স্থানীয় কয়েকজন লোক। তাঁরা জায়গা দখলে নিতে কোনো ধরনের ঝামেলা না করতে লাক্কাতুরা চা-বাগানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে নানা রকম প্রস্তাব ও দফারফা করতে তৎপর হয়। এ সময় পুরো বিষয়টি এনটিসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলে ভূমি মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করার পর স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ভুয়া স্মারক তৈরির বিষয়ে অবহিত হয় এনটিসি। ওই বছরের ২১ নভেম্বর এনটিসির পক্ষ থেকে লাক্কাতুরা চা-বাগানের ব্যবস্থাপনা দপ্তর থেকে এ–সংক্রান্ত একটি পত্র দিলে জেলা প্রশাসন গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নামজারি বাতিল করে।

জালিয়াতির মাধ্যমে নামজারি সম্পন্নের সময় সিলেট সদরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) দায়িত্বে থাকা নারী কর্মকর্তা বর্তমানে বদলি হয়ে অন্য একটি উপজেলায় কর্মরত আছেন। ওই সময় তাঁর দপ্তরে ভূমি ব্যবসায়ীদের যাতায়াত পর্যবেক্ষণ থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, নামজারি হওয়া ব্যক্তি শামছুজ্জামান চৌধুরীকে তাঁরা কেউ কখনো দেখেননি। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে থাকা একজন পরিচিত ভূমি ব্যবসায়ীকে তাঁরা দেখেছেন। তিনি শামসুজ্জামান চৌধুরীর বাড়ি সিলেট সদরের ঘোপাল বলে জানিয়েছেন। তবে ওই এলাকায় দুই দফা গিয়েও শামসুজ্জামান নামের কাউকে পাওয়া যায়নি। এলাকাবাসী কেউ এ নামের কাউকে চেনেননি এবং দেখেননি বলে জানিয়েছেন।

লাক্কাতুরা চা-বাগানের যে জায়গা নামজারি করা হয়েছিল, এ জায়গাটি পড়েছে সিলেট নগরের শাহি ঈদগাহ এলাকার উত্তর–পূর্ব দিকে। শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামের বিপরীত দিকে একটি ‘ডুপ্লেক্স হাউজিং’ এলাকার পর ওই জায়গার অবস্থান। গত শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, টিলাবেষ্টিত পুরো জায়গা চা-বাগান ও রাবারবাগান। একাংশে চা-শ্রমিকদের বসতিও রয়েছে। বসতি এলাকার বাসিন্দা দুজন প্রবীণ চা-শ্রমিক জানান, জায়গাটি সরকারই আবাসনের জন্য বন্দোবস্ত দিয়েছে—এ রকম কথা বলে প্রায় ছয় মাস ধরে কিছু লোকের আনাগোনা ছিল। তবে গত দু-তিন মাস হয় এঁদের আর দেখা যায়নি।

লাক্কাতুরা চা-বাগানের পশ্চিম দিকে পড়েছে তারাপুর চা-বাগান। জালিয়াতির মাধ্যমে তারাপুর চা-বাগানের মতো লাক্কাতুরা চা-বাগানের পরিণতি হতে যাচ্ছিল—এমন উৎকণ্ঠা চা-বাগান পরিচালনায় থাকা দপ্তরগুলোতে কর্মরত ব্যক্তিদের মধ্যে। তাঁরা তারাপুরের মতো লাক্কাতুরা চা-বাগানের ভূমি জালিয়াত চক্রকে সামনে এনে চা-ভূমি দখলচেষ্টায় আড়ালে থাকা প্রভাবশালী ভূমি ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

এ ব্যাপারে এনটিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল আউয়াল বলেন, যেহেতু লাক্কাতুরার চা-ভূমি সরকারের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত হিসেবে পাওয়া, তাই শতকোটি টাকার জমি জালিয়াতির পেছনের চক্রকে ধরতে প্রশাসনকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

সূত্র : প্রথম আলো

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.