Sylhet Today 24 PRINT

দারিদ্রতার সাথে আছে অসচেতনতা আর কুসংস্কার

হাকালুকি পাড়ের জেলে পল্লী

এস আলম সুমন, কুলাউড়া |  ২১ এপ্রিল, ২০১৯

দুই জেলার কয়েকটি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃর্ণ হাকালুকির হাওর। এরমধ্যে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা অংশে হাওর তীরবর্তী ৪টি গ্রামে দুই সহস্রাধিক মৎস্যজীবী পরিবারের বসবাস। দারিদ্রতার সঙ্গে এই জেলে পল্লীর বাসিন্দাদের নিত্য বসবাস। অসচেতনতা আর কুসংস্কারও প্রকট এখানে। ফলে মানব উন্নয়ন সূচকের সব ধাপেই পিছিয়ে আছে তারা।

উপজেলার হাওর তীরবর্তী ভূকশিমইল ইউনিয়নের উত্তর ও দক্ষিণ সাদিপুর, জয়চণ্ডী ইউনিয়নের মীর শংকর, বরমচাল ইউনিয়নের আলীনগর গ্রামে দুই সহস্রাধিক পরিবারের জনসংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।

ঘনবসতিপূর্ণ এসব গ্রামের লোকজনদের মধ্যে নেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে কোন সচেতনতা। পিঠাপিঠি বয়সের ৬ থেকে ৭টি সন্তান নিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে জরাজীর্ণ খুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে বাস করছে প্রতিটি পরিবার। জন্মনিয়ন্ত্রণ ও সন্তানদের চিকিৎসা বিশেষ করে শিশুদের টিকা প্রদানে রয়েছে কুসংস্কার। নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থা।

জেলেপল্লীর মৎস্যজীবীরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারেও উদাসীন। এলাকার অধিকাংশ ছেলে মেয়ে বিদ্যালয়ে যায় না। যারা যায় তাদের বেশিরভাগ প্রাথমিকেই ঝরে পড়ে। বিভিন্ন সময় এসব এলাকায় সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে অনেক এনজিও সংস্থা। কিন্তু তাদের দায়সারা কার্যক্রমে এসব এলাকায় কোন সুফল আসে না।

ঘনবসতিপূর্ণ জেলেপল্লীর লোকজনের স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের জন্য এ এলাকায় নেই কোন কমিউনিটি ক্লিনিক। শুধু পরিবার পরিকল্পনা ও টিকা সম্প্রসারণ কর্মসূচির (ইপিআই) মাঠকর্মীরা সেবা এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম প্রদান করেন। স্বাস্থ্য সেবার গ্রহণে আসতে হয় শহরে অবস্থিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। গ্রাম থেকে হাসপাতাল দূরে তাই অনেকেই এ ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। নেই পর্যাপ্ত সুপেয় পানির ব্যবস্থা। এভাবেই চলছে জেলে পল্লীর মানুষদের জীবন-সংগ্রাম।

সরেজমিনে সাদিপুর, মীরশংকর, আলীনগর জেলে পল্লী এলাকায় গেলে দেখা যায়, চারিদিকে স্যাঁতস্যাঁতে জলাবদ্ধ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ময়লা আবর্জনায় ভরা পুকুর, খোলা পায়খানা। খোলা পায়খানার বর্জ্য পুকুরের পানিতে পড়ে পানি দূষিত হচ্ছে। গোসল, কাপড় আর রান্নার হাড়িপাতিল ধোয়াসহ সবকিছুই এসব পুকুরের দূষিত পানি দিয়েই করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি ঘর ঘেষেই রয়েছে ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত পানি। জরাজীর্ণ ৫ থেকে ৭ ফুট বর্গাকৃতির খুপড়ি ঘরে একাধিক সন্তান নিয়ে বাস করছেন অনেক মৎস্যজীবী। এমনকি রান্না, শোবার ব্যবস্থাসহ হাঁস মোরগ, গবাদিপশুর সাথে একই ঘরে শিশুসন্তান নিয়ে বাস করছে অনেক পরিবার।

সাদিপুরে ইপিআই কর্মসূচি কর্য়ক্রম পরিচালনার সময় কথা হয় স্বাস্থ্যকর্মী মো. সিরাজ মিয়া ও পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী শিখা রাণী দাসের সাথে। তারা জানান, এই এলাকা অধিক জনবসতিপূর্ণ। তাই সাদিপুর, উত্তর সাদিপুর ও মীরশংকর এই তিনটি গ্রামকে তিনটি ব্লক করে ২৮ দিন পর পর টিকা সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

সিরাজ মিয়া জানান, টিকা সম্প্রসারণ কর্মসূচির আওতায় ২০১৭ সালে ১০৯ জন শিশুকে, ২০১৮ সালে ৭৮ জন শিশুকে এবং চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ২৬ জন শিশুকে বিভিন্ন রোগের টিকা প্রদান করা হয়। তিনি বলেন, এসব এলাকার অনেক মা বাবাকে বুঝিয়ে তাদের শিশু সন্তানকে এনে টিকা প্রদান করি। আবার কিছু মা বাবা টিকা দেওয়ার পর জ্বর আসবে এমন নানা ভ্রান্ত ধারণার জন্য শিশু সন্তানকে টিকা দেওয়া ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তবুও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি।

পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মী শিখা রাণী বলেন, এই তিন গ্রামে বর্তমানে ৭শ’ ৬৬ জন সন্তান ধারণে সক্ষম দম্পতি রয়েছেন। তাদের অধিকাংশই জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নানা কুসংস্কারে বিশ্বাসী। অনেক নারী জন্মনিয়ন্ত্রণের আগ্রহ থাকলেও স্বামী ও শশুর শাশুড়ীর আপত্তির কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন না। আবার অনেক পিল জন্মনিয়ন্ত্রণে পিল নিলেও সেটি সময়মতো সেবন করেন না।

ওই এলাকার বাসিন্দা রুশম আলীর স্ত্রী দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জননী রুবী বেগম, সামছুল ইসলামের স্ত্রী ৩ কন্যা সন্তানের জননী রুশেমা বেগম, গাজী মিয়ার স্ত্রী তিন ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জননী রাফিয়া বেগম বলেন, সন্তানদেরকে টিকা দিতে আসছি তবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে পরিবারের (স্বামী, শশুর ও শ্বাশুড়ীর) নিষেধ আছে তাই নিচ্ছি না।

মৎস্যজীবি রিয়াজুল ইসলামের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা তরিজা বেগমের (৩১) হাসান হোসেন (৫), আয়েশা বেগম (৭) খাদিজা বেগম (৮) নামে তিন সন্তান রয়েছে। তরিজা বলেন, স্বামীর নিষেধ থাকায় সন্তানদের কোন টিকা দেননি। গর্ভাবস্থায় তিনি নিজেও কোন টিকা নেননি। এ সময় তাঁর পাশে থাকা ছেলে হাসানের হাত পা ও মুখে খোস-পাঁচড়া দেখা যায়।

৭ সন্তানের জননী আজিদা বেগম ও ৪ সন্তানের জননী হাবিবুন বেগম বলেন, সব সন্তানকে টিকা প্রদান করলেও ছোট সন্তানকে টিকা দেননি। হাবিবুন জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য পিল ব্যবহার করলেও আজিদা জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন পদ্ধতি গ্রহণ করেননি বলে জানান। সন্তানদের পড়াশুনার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে আজিদা ও হাবিবুন বলেন স্কুলে ভর্তি করেছিলাম, কিছুদিন স্কুলে গিয়ে আর যায় না। অভাবের সংসারে ছেলে মেয়ের পড়ার খরচ জোগাড় করা খুবই কষ্টকর। তাই আর চাপ দেই না।

৫ কন্যা সন্তানের জনক মৎস্যজীবি বারাম আলী বলেন, ছোট দুই মেয়ে প্রাইমারি স্কুলে যায়। বড় তিন মেয়ের পড়াশুনা বন্ধ। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নেইনি ও সন্তানদের কোন টিকা দেইনি।

৮ কন্যা সন্তানের জননী সায়ারুন বেগম (৪৫) এবং ৩ ছেলে, ৩ কন্য সন্তানের জননী মমতা বেগম (৩৫) জানান, বর্তমানে আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছি। সব ছেলে মেয়েকে টিকা দেওয়াইনি।

সন্তানরা পড়াশুনা করে কিনা এ বিষয়ে তারা বলেন, কিছুদিন স্কুলে গিয়েছিলো এখন আর যায় না।

৫ সন্তানের জননী ফাতেমা বেগম ও ২ সন্তানের জনক মৎস্যজীবি হাফিজুর রহমান বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন পদ্ধতি ব্যবহার করি না। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।

এদিকে বরমচাল ইউনিয়নের আলীনগরে গেলে দেখা যায়, সেখানে প্রায় আড়াই শতাধিক পরিবারের বসবাস। এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ মৎস্যজীবি। তবে শুকনো মৌসুম আসলে হাকালুকি হাওর ও এর আশেপাশে পানি কমে যাওয়ায় কিছু লোক দিন মজুরের কাজ করেন। এলাকার পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। ময়লা ও কাদা পানির মধ্যে খেলা করছে শিশুরা। অসচেতনতা, কুসংস্কার এবং দারিদ্রতা এই এলাকায়ও প্রকট। এই এলাকায় পরিবার পরিকল্পনার তেমন কার্যক্রম নেই।

আলীনগরে ৭ সন্তানের জননী জাহানারা বেগম ও ৮ সন্তানের জননী হোসনে আরার সাথে কথা হলে তাঁরা বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন পদ্ধতি নেইনি। অভাবের কারণে সব সন্তানেদেরকে স্কুলে পাঠাতে পারিনি। জাহানারা বলেন, তিন সন্তানকে টিকা দিয়েছি। শ্বশুর না করায় চার সন্তানকে টিকা দেইনি। এলাকায় বেশ কয়েকটি পরিবারে গিয়ে দেখা যায় প্রতিটি পরিবারে ৩ থেকে ৬ জন সন্তান রয়েছে। তবে এ এলাকার অধিকাংশ শিশু টিকাদান সম্প্রসারণ কর্মসূচির আওতায় রয়েছে।

উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মধুসূধন পাল চৌধুরী বলেন, আলীনগর, সাদিপুর ও মীরশংকর এলাকার মানুষ অনেকটাই অসেচতন। সাদিপুর ও মীরশংকরে পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মী জন্মনিয়ন্ত্রণসহ সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। আলীনগরে পরিবার পরিকল্পনার যে মাঠকর্মী ছিলেন তিনি অবসরে যাওয়ায় সেখানে কার্যক্রম আপাতত বন্ধ। শীঘ্রই আবার এ এলাকায় মাঠকর্মী দেওয়া হবে।

মৌলভীবাজার জেলা সিভিল সার্জন শাহজান কবির চৌধুরী মোবাইল ফোনে বলেন, পরিবার পরিকল্পনার বিভাগ আলাদা। পুরো উপজেলাজুড়ে টিকা সম্প্রসারণ কর্মসূচি (ইপিআই) কার্যক্রম বেশ ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সাদিপুর, মীরশংকর ও আলীনগর এলাকার শিশু এবং গর্ভবতী মাকে শতভাগ ইপিআই কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যক্রম আরো তরান্বিত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ শীঘ্রই নেয়া হবে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.