Sylhet Today 24 PRINT

সুরমার বুকে ঘাস!

চর পড়ে ও তলদেশ ভরাট হয়ে শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে সুরমা নদী, আটকে আছে খননের উদ্যোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক |  ১২ মার্চ, ২০২০

সিলেট নগরীর শাহজালাল সেতু থেকে দক্ষিণ সুরমার শ্রীরামপুর পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকাজুড়ে সুরমার বুকে জেগেছে দীর্ঘ চর। চরের উপর গজিয়েছে ঘাস। দেখে যে কারো পতিত জমি মনে হতে পারে। দুইপাশে গজিয়ে ওঠা চরের মাঝখান দিয়ে বইছে সরু পানির ধারা। নদী নয়, যেনো  মরা খাল। এক সময়ের খরস্রোতা সুরমা নদীর এখন এমনই জীর্ণদশা।

কেবল নগরীর আর আশপাশের এই এলাকায়ই নয়, দেশের দীর্ঘতম এই নদীর প্রায় পুরোটাজুড়েই এখন এমন করুণ অবস্থা। সুরমা নদীর উৎসমুখ জকিগঞ্জের আমলসীদ থেকে কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়ার সংযোগস্থল পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার এলাকায় ৩৫টির চর জেগেছে। তলদেশ ভরাট হওয়ার ফলে শুষ্ক মৌসুমে যেমন পুরো নদীই প্রায় ভরাট হয়ে যায় তেমনি বর্ষাকালে অল্পবৃষ্টিতেই দেখা দেয় বন্যা। আর নদীর দুই তীরে সৃষ্টি হয় তীব্র ভাঙ্গনের। সিলেট অঞ্চলের প্রধানতম এই নদী ভরাট হয়ে পড়ায় বন্ধ হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক পণ্য পরিবহন। ফলে বাড়ছে পণ্যপরিবহণ ব্যয়।

সুরমাকে বাঁচাতে ১৯৯৭ সালে এই নদী খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও আজ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তরা বলছেন, এই নদীর অন্তত ২৫-৩০ কিলোমিটার অংশ বাংলাদেশ ও ভারত- দুই দেশের সীমান্ত এলাকায়। ফলে ভারতের সম্মতি না পাওয়ায় খননের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এরপর ২০১৮ সালে সিলেট সদর ও বিশ্বনাথ এলাকার নদীর কিছু চর খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এটি এখনও জরিপ পর্যায়ে রয়েছে।

জানা যায়, ভারতের বরাক নদ আসামের করিমগঞ্জ হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলশিদ এলাকায় সুরমা ও কুশিয়ারা নামে ভাগ হয়েছে। সুরমা সিলেটের কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ ও সিলেট সদর হয়ে সুনামগঞ্জে গিয়ে মিশেছে। প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ সুরমা নদীর ১১০ কিলোমিটারই পড়েছে সিলেটে। গত দুই দশকে এই ১১০ কিলোমিটারের ৪০-৪৫ শতাংশ অংশে চর পড়েছে। যেখানে চর পড়েনি, সেখানে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে।

মঙ্গলবার দক্ষিণ সুরমার কুশিঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পুরো নদী শুকিয়ে শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে খেলা করছে শিশু-কিশোররা। চরের মধ্যে আটকে আছে দুটি বালুবাহী কার্গো। দু’একটি খেয়া নৌকা ছাড়া আর কোনো পরিবহন নেই নদীতে।

কুশিঘাট এলাকার প্রবীন বাসিন্দা রমিজ উদ্দিন (৭০) বলেন, এই নদী দিয়ে আমরাও জাহাজ চলাচল করতে দেখেছি। এখন তো শুষ্ক মৌসুমে নৌকাও চলে না। অথচ বর্ষায় তীর উপচে আশাপাশের এলাকা ভাসিয়ে দেয় নদীর পানি।  

নগরীর কাজিরবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর শুকিয়ে যাওয়া অংশে আবর্জনা ফেলে ভরাট করে ফেলেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। রীতিমত আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে নদীর তীর।

জানা যায়, উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ে বৃষ্টি হলে উজান থেকে পাহাড়ি ঢল হয়ে নেমে আসে সেই পানি। যে পানিতে থাকে উদাম পাহাড় ধুয়ে বালি ও মাটি। আর এই বালি ও মাটি বছরের পর বছর ধরে জমে সুরমাসহ সিলেট বিভাগের নদ-নদী ভরাট করে ফেলছে। খননের উদ্যোগ না থাকায় নদীই এখন অস্তিত্ব সংকটে।

নদীরক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ায়াটারকিপার এলায়েরেন্সর সদস্য, সুরাম রিভার ওয়াটারকিপার আব্দুল করিম কিম বলেন, অতীতে এক অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নামলে ছোট ছোট নদী ও খাল দিয়ে দ্রুত প্রবাহিত হয়ে অন্য অঞ্চলে দ্রুত অপসারণ হয়ে যেত। কিন্তু নদনদীগুলো, বিশেষত সুরমা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি এখন দ্রুত অপসারণ হয় না। ফলে বর্ষা মৌসুমে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে এ নদীর বিস্তির্ন এলাকা জুড়ে চর পড়ে পানিশূন্য হয়ে পড়ছে পুরো নদী। উত্তরপূর্ব ভারতে অবাধে বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় টিলা কাটার ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ি ঢলের সাথে ও আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে বালি ও মাটি আসার পরিমাণ আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান তিনি।

সুরমা নদীর জকিগঞ্জের আমলসীদ থেকে কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়ার সংযোগস্থল পর্যন্ত সুরমা নদীর ৩২ কিলোমিটার এলাকায় ৩৫টির চর জেগেছে জানিয়ে কিম বলেন, দ্রুত এই নদী খনন করা না গেলে এই এলাকার মানুষ আগামীতে আরো বিপদে পড়বে।
 
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালেই সুরমা নদী খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে যৌথ নদী হওয়ায় মাঝপথেই থেমে যায় সে উদ্যোগ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ১৯৯৭ সালে একবার সুরমা নদীর উৎসমুখ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। তখন কিছু জরিপ কাজও চলে। কিন্তু ভারতের সম্মতি না মেলায় সে উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যায়নি।

তিনি বলেন, ২০১৮ সালে পাউবো’র ঢাকার কার্যালয় থেকে সিলেট ও বিশ্বনাথ উপজেলায় সুরমা নদীর জেগে ওঠা চর খননের একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করা হয়। মন্ত্রণালয় থেকে এটি প্রাথমিক অনুমোদন করে যাচাই-বাছাই ও জরিপ করার জন্য বলা হয়েছে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.