Sylhet Today 24 PRINT

আরশিনগর পরিভ্রমণের একঝলক

আহমদ সায়েম |  ০১ ডিসেম্বর, ২০১৫

দেশে-দেশে অর্থনৈতিক মন্দা আর যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় ছেয়ে গেছে সারাটা বিশ্ব। কেউ অস্ত্র নিয়ে লড়ছে শত্রুর বিরুদ্ধে; তিন বছরের বাচ্চাটাও যুদ্ধে ব্যস্ত, সে লড়ছে গেইম-পোর্টালে। ব্যস্ত আছি আমিও; তবে যুদ্ধে নয়, প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে। এখনও সুলভে পাওয়া যাচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্য। আর তা গ্রহণ করার একটাই মাধ্যম, নিজের ইচ্ছেশক্তি।

ভালো লাগা কেউ কাউকে দেয় না, তা কুড়িয়ে নিতে হয়। সুন্দর কিছু খোঁজার জন্য দূর পাহাড়ে উঠতে হবে না, ঘরের বারান্দায় বসে বসে চায়ে চুমুক দিয়েও স্বপ্ন দেখা যায়। কথাগুলো কাউকে উদ্দেশ্য করে বলছি না, নিজের পকেটে হাত দিয়ে আনন্দের ভাঁজ খোলার চেষ্টা মাত্র। দূরে কোথাও না-গিয়ে জানালায় বসে বসে পাখিটার সাথে ভাব জমাই, বউয়ের সাথে প্রেম করে রটিয়ে দেই প্রেমিকার নাম কবিতায়।

সিলেট শহরের কাছেপিঠে সব আত্নীয়স্বজনদের বাড়িঘর হওয়ার কারণে সামান্য দূরের শহরটাও দেখা হয়নি এই সান্ধ্য বয়সে এসেও। ঘণ্টাখানেক সময়ের পরে শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশনে নেমে মনে হচ্ছে দূরের কোনো শহরে নামলাম। অপরিচিত গন্ধ, মানুষ, রেলস্টেশনের পাশেই যে-দিঘিটা তার চারপাশে জানা-অজানা বৃক্ষের লাইন; আট-নয়টি হাঁস প্রেমে মাত হয়ে আছে জলের গন্ধে ও রঙে। আমি নিজেও-যে দিঘির গন্ধে মত্ত হয়ে ছিলাম তা বুঝতে পারি নিজের গন্তব্যে পৌঁছার পরে, কারণ এই দিঘিটার কোনো নাম আছে কি না তা জানার জন্যে কোনো খেয়াল থাকেনি তখন।

নাজিমভাই (মো. নাজিম উদ্দিন) আর আমি হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর পর্যন্ত গেছি, কিন্তু দিঘির টানে ফের ফিরে আসি তারই ছায়ায়। চারপাশ ঘুরে-ঘুরে দেখি আর হাঁটি। পুরাতন ভাঙ্গারুঙ্গা একটা ঘাট আছে, যেখানে এলাকার ছেলেমেয়েরা আর নারীপুরুষ অনেকেই গা-হাতপা ধুচ্ছেন। আমরা দুইজন হাঁটতে-হাঁটতে ঢুকে পড়ি পাশের মহল্লায়, বেশি ভেতরে আর যাওয়া হয় না। হাঁটার রাস্তার বাঁ-পাশেই ছাপড়া মতন একটা দোকান আর তার পাশেই বড় বাঁশঝাড়, যেন সেও খুলে বসেছে বাতাসের দোকান। নিচে বাঁশবেতের বেঞ্চি পেতে রাখা ছিল, আমরা ওখানেই বসি আর মহল্লার ছেলেমেয়েদের চরিত্র ধারণ করার চেষ্টা চালাই।

ক্লাস ফোরে পড়ুয়া লিপি নামের একটা মেয়ে আমাদের জিজ্ঞেস করল—‘আপনেরা কই থেকে আইছেন।’আমরা মনে হয় তার প্রশ্নের উত্তর আর দিলাম না, না-দিয়েই তার কাছে জানতে চাইলাম তার নাম আর সে কিসে পড়ে। সে স্কুলে যাবে তাই আমাদেরকে সময় দেয়ার মতো তার হাতে সময় নেই, নিচের দিকে তাকিয়ে দিলো দৌড়। মেয়েটা ঐ দিঘি থেকে গোসল সেরে ফিরছিল। আমরা আলাপ জমাই এলাকার প্রতিবন্ধী একজন চাচার সাথে, যিনি হাঁটতে পারেন না, কিন্তু গল্প করেন খুব মজা করে। চাচা দেশ ও জাতিকে নিয়ে উনার গভীর চিন্তাভাবনার কথা আমাদের সাথে শেয়ার করলেন, আমরা তা দিলসে শোনার চেষ্টা করলাম আর এলাকার চায়ে নেশা ঝাড়লাম।

আমাদের আজকের গন্তব্য কিন্তু এই রেলস্টেশন নয়, ছয়-সাতশ বছরের পুরাতন মসজিদ দেখতে যাব এমন প্ল্যান করে ভোরে চারজনেরই দেখা হওয়ার কথা রেলস্টেশনে, কিন্তু আমি আর নাজিমভাই সময়মতো সিট নিয়ে বসতে পারলেও অন্য দুইজন দেবাশীষ দেবু ও আবদুল বাতিন আসার আগেই স্টেশন ছেড়ে চলে আসে ট্রেন। তারা দুইজন একটা সিএনজি নিয়ে ট্রেনের পিছু নেন, আমরা ট্রেনের জানালায় বসে এবং তাদেরকে দেখে দেখে মোবাইলে আলাপ করি আর ট্রেনের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে ছুটতে থাকে তাদের সিএনজি। এক-সময় তারা তাল হারিয়ে ফেলেন, বাড়তে থাকে দূরত্ব। পর-পর দুইটা স্টেশনে তারা ট্রেন ধরতে না-পেরে সিএনজি ছাড়েন এবং অন্য ট্রেনের অপেক্ষা করেন। প্রায় দুই ঘণ্টা লেটে তাদের সাথে যুক্ত হই এবং আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।


যে যা ধারণ করে তার অত ধারণা থাকে না বিষয়টা নিয়ে, কথাটার সহজ প্রমাণ পাওয়া গেল শায়েস্তাগঞ্জের গ্রামে পা দিয়েই। প্রত্নতত্ত্ব, আর্কিওলজি বা পুরাকীর্তি আমরা যে নামেই মূল্যায়নটা বুঝি না কেন, যারা পুরাকীর্তির সঙ্গে সংসার করছে তাদের অত আহ্লাদ নেই বিষয়টার প্রতি। আমরা চারজন পুরাকীর্তির কীর্তি দেখতে মানে মসজিদটা দেখতে যাচ্ছি, অথচ এলাকার দুইটা ছেলে শুনে মুখ-টিপে হাসতেছে! ছেলে দুইটার কথা না-হয় বাদই দিলাম, যারা মসজিদ কমিটির সাথে রয়েছেন তারা গায়বি মসজিদ বা অতি-পুরাতন মসজিদ হিসেবে তার মূল্যায়ন করছেন কিন্তু আর্কিওলজির কাজ হিসেবে কোনো মূল্যায়ন তাদের মধ্যে পাওয়া যায়নি। তারা তাদের প্রয়োজনে লোহা গাড়ছেন, ভেতরে স্থান সঙ্কুলানের জন্য বাইরে ঢেউটিন দিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছেন নামাজিদের জন্য স্থান। ইমাম ও মোয়াজ্জিনের থাকার ব্যবস্থা করেছে মসজিদের সাইটেই, আরেকটা ইমারত গড়ে, যা মূল মসজিদের সৌন্দর্য অনেকটা আড়াল ও অন্ধকার করে দিয়েছে।

আর্কিওলজি বা পুরাকীর্তি বলতে সাধারণভাবে আমরা সময়ের গহ্বরে একটি সভ্যতার বা একটি যুগের বিলীন-হয়ে-যাওয়া নিদর্শনের অবশিষ্টাংশের কথা বুঝি। আর যখন সেই ইতিহাসের নিদর্শনকে আশেপাশের মানুষের জীবনযাপনের ধারা এবং সমাজ ও অর্থনীতি সহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট করা হয় তখন সেই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘কমিউনিটি আর্কিওলজি’ বা ‘গোষ্ঠী পুরাকীর্তি’; অর্থাৎ যে-পুরাকীর্তি ‘মানুষের দ্বারা মানুষের জন্য’ তাকেই বলা হয় ‘গোষ্ঠী পুরাকীর্তি’। তা, আমরা এই মসজিদটাকে কি বলব? যে যা-ই বলুক পুরাকীর্তিই তো।

মসজিদের নাম উচাইল শাহি জামে মসজিদ, এই নাম লেখা দেখা যায় তাদের নামাজের স্থায়ী সময়সূচিতে। কিন্তু ৩৭ বছর ধরে যে ইমাম সাহেব ইমামতি করছেন, মোহাম্মদ ফজলুল হক, তিনি মসজিদের নাম বললেন গায়বি মসজিদ। এলাকা বা বাইরের পরিচিতিও এই নামেই। শঙ্কর পাশা শাহি জামে মসজিদ নামটাও স্থানীয়-লোকজনের মুখে শুনা যায়।



মসজিদের বয়স ঠিকমতো কেউ বলতে পারলেন না, কেউ ৫০০, কেউ ৭০০ বছরের পুরাতন বলে জানালেন। হজরত শাহজালালের (র.) এর সঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার একজন হচ্ছেন শাহ্ মজলিস আমিন। উনার হাতেই প্রতিষ্ঠা পায় এই মসজিদ। শত শত বছর পরে মাওলানা আব্দুল কাদির স্বপ্ন দেখেন যে এই জঙ্গলে একটা মসজিদ রয়েছে, পরে এলাকার মানুষজন নিয়া তিনি উদ্ধারের কাজে হাত লাগান। ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের আমলে রিপিয়ারিং এর কাজ করে এর সৌন্দর্য বাড়ানো হয় কিন্তু এর ভেতরের মজবুতিরকাজ শেষ না করেই নির্মাণকাজের ইতি টানা হয়। এই কারণেই স্থাপনাটি নির্মাণসময় থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ, যে-কোনো সময় বড় কোনো বিপদের সম্মুখিন হতে হবে এলাকাবাসীকে, এমন মনে করেন চেয়ারম্যানবাড়ির আখতারুজ্জামান ঝালু।

এই মসজিদ এখন আর শুধু এলাকারই সম্পদ নয়, এটা দেশের সম্পদ, এটা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যেরও অংশ। একে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে, এলাকার মানুষজন ছাড়াও দেশের সবাইকেএর মূল্যবোধ ও গুরুত্বটুকু বোঝা দরকার। ‘গায়বি মসজিদ’ হিসেবে দূরদুরান্ত থেকে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নানান ধর্মের মানুষজন অনেক রকম মানত নিয়ে আসতে দেখেছি আমরা। তাই মসজিদের প্রতি সরকারের আরোও আন্তরিক হয়ে এইটিকে একটি দৃষ্টিনন্দন স্থান হিসেবে গড়ে তোলা উচিৎ। এতে করেদেশবিদেশের পর্যটকদের আনাগোনা বাড়বে, আর এলাকায় পর্যটক বাড়লে আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন আসবে, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তির ধ্বংস রোধ করা সম্ভব হবে এবং সেইসঙ্গে এর রক্ষণাবেক্ষণও সহজসাধ্য হবে।

আহমদ সায়েম : কবি ও প্রাবন্ধিক । লিটলম্যাগ সূনৃত এবং ওয়েবম্যাগ রাশপ্রিন্ট র সম্পাদক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.