Sylhet Today 24 PRINT

নদীর নাম সই লোভাছড়া

ফারুখ আহমেদ |  ২৮ মে, ২০১৬

একটু আগেও খটখটে রোদ ছিল। এখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সে বৃষ্টির ছাট আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। বেত আর পলিথিনের ফুটো চাল বেয়ে টপটপিয়ে পড়ছে পানি। আমরা পাঁচজন গা ঘেঁসাঘেঁসি করে বসে তাকিয়ে দূর আকাশের পানে। যেখানে রোদ্ররা খেলা করছে পাহাড়ের গায়ে, সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অথচ কাছেই চরাচর ঝাঁপসা করে বৃষ্টি হচ্ছে, আর সে বৃষ্টি মাথায় আমাদের ছোট নৌকা এগিয়ে চলেছে ভারত সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাদদেশের ঝুলন্ত ব্রীজের দিকে।


সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার একেবারে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় খাসিয়া-জৈইন্তা পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে বালুভরা বেশ কিছু স্বচ্ছ পানির নদী। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে লোভাছড়া নদী। নদীর প্রতি আমাদের সবারই রয়েছে অসম্ভব টান। আর নদীর নাম লোভাছড়া নাম শুনে তো প্রেমে পরার অবস্থা। কিন্তু সময় সুযোগ দুটোর সম্মিলন না হওয়ায় যাই যাই করেও যাওয়া হচ্ছিলনা। শেষ পর্যন্ত এবার বরষার শুরুতে সুযোগ পেয়ে লোভায় বেড়ানোর ইচ্ছে আর দমিয়ে না রেখে সিলেট রওনা হলাম। পরদিন সিলেট শহর থেকে সকাল সকাল লোভার উদ্দেশ্যে যাত্রা। সঙ্গী বিনয় ভদ্র, রাজীব রাসেল, পিয়েল আর সেতু। জকিগঞ্জের সে পথে আগে কখনও যাইনি। পথে কতনা গ্রাম, জনপদ আর মাঠ পেরিয়ে ভুল রাস্তা হয়ে অপরিচিত এক গ্রামে পৌঁছি দুপুর বারটায়। সেখানে আমরা ছোট্ট একটা বাজার পেয়ে ক্ষিধার পেট ভরিয়ে নেই। এরপর স্থানীয় এক বয়স্ক ব্যাক্তির সঙ্গে কথা। এবার আমাদের রাস্তা চেনা হয়ে যায়। আমরা সেই চেনা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলি। কিন্তু পিচ পথ ছেড়ে মেঠো পথে চলতেই চালক যাত্রা বিরতী টানেন। অতিরিক্ত কাঁদামাখা পথ বিধায় চালক আর সামনে এগুতে সাহস পেলেননা, কী আর করা। আমরা সিএনজি চালিত অটো রিকসা ছেঁড়ে পায়ে চলা সরুমেঠো পথে পা বাড়াই। কর্দমাক্ত সে পথে চলতে কিন্তু মন্দ লাগছিল না। কিছুটা হেঁটে আমরা বাঁশসুন্দীরর পথ ধরি। পথের দুইধারে ঘন বাঁশের জঙ্গল। সে সব বাঁশগাছের সারি যেন কুর্নিশ করে আমাদের স্বাগত জনাচ্ছিল। এখন বর্ষাকাল বোঝার উপায় পুরো পথই কাঁদায় মাখামাখি। সেই কাদায় ভরা বাঁশ পথ ধরে কিছুটা হেঁটে আমরা পেয়ে যাই আমাদের কাংখিত লোভারমুখ। আমাদের সামনে এখন সুরমা নদী। লোভার মুখে দাঁড়িয়ে দেখি দুরের মেঘালয় পর্বতমালা আর লোভাছড়ানদী। এখান থেকে আমাদের বাহন হবে নৌকা।

চলেছি পরিচ্ছন্ন সুরমা নদী দিয়ে। লোভার মুখ হচ্ছে সুরমা ও লোভাছড়া নদীর সঙ্গমস্থল। সুরমা নদী দিয়ে আমাদের ইঞ্জিন চালিত নৌকা ছুটে চলে লোভাছড়া নদী অভিমূখে। নদীর বুক ভীর করা নৌকা নেই। একটা দুটো ইঞ্জিন চালিত নৌকা হঠাৎ হঠাৎ ঢেউ খেলিয়ে চলে যাচ্ছে। দুরে পাহাড়ের বুকে সুর্যের আলো। এসব মিলিয়ে যেন আমাদের এক অচিন দেশ ভ্রমন। সুরমা পেরিয়ে আমাদের যাত্রা লোভাছড়ায় শুরু হতেই শুরু হল এক চঞ্চলতা। সামনে মনোরম সৌন্দর্য দেখলে চঞ্চলতা তো আসবেই। সঙ্গে বেশ জোড় হাওয়া চারিদিক ছড়িয়ে আমাদের নৌকায় আছড়ে পড়ল, আছড়ে পড়ল আমাদের চোখে মুখে। মজার ব্যাপার হল আমাদের সঙ্গে কোনও লাইফ জ্যাকেট নাই। তবু মনে কোনও ভয় ডর নাই। চারিপাশের সৌন্দর্য মনে একটা কথার উদ্রেক করে চলল কেবল- এ কোথায় এলাম! চোখের সামনে লোভার উথাল পাথাল ঢেউ আর অঝোর ধারায় বৃষ্টি। আবার দুরে আঁকাবাঁকা পাহাড়ের গায়ে সুর্যের উকিঝুকি আর সবুজের ঝিলিক। এসব দেখতে দেখতে আমাদের জলভ্রমন এগিয়ে চলল। কিন্তু বিকাল ঘনিয়ে আসায় ভারত সীমান্তবর্তী ঝুলন্ত সেতুর পথ ছেড়ে আমরা লোভাছড়া চা বাগানের দিকে নৌকা ঘুরাই। পথিমধ্যে বাগানবাজারে চা পানের বিরতী দিয়ে আবার এগিয়ে চলে আমাদের জলভ্রমন! এবার নৌকা চলছে লোভাছড়া চাবাগানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা খাল দিয়ে। এভাবেই আঁকাবাঁকা জলপথ ধরে যখন আমরা ১৯২৫ সালে নির্মিত লোভাছড়া চাবাগানের ঝুলন্ত সেতুর কাছে পৌঁছে যাই, সে সময় গোধুলী বেলা। সেই গোধুলীতে আমাদের উচ্ছাস আনন্দ চোখে দেখার মত। সত্যি বলতে কীএমন গোধুলী বেলার কথা আজীবন মনে থাকবে!


প্রয়োজনীয় তথ্য

লোভা নদী আর লোভা ছড়া চা বাগান যেতে হলে আপনাকে সিলেট শহর থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনার গন্তব্য হবে কানাইঘাট। আমরা কানাইঘাট ঘুর পথে গিয়েছিলাম। সিলেট থেকে যাত্রা শুরু করে গোলাপগঞ্জ, চারখাই আর শাহবাগ পেছেনে ফেলে জকিগঞ্জের পথ ধরে আমরা কানাইঘাট উপজেলা লোভার মুখ পৌঁছি। তারপর নৌকা ভাড়া করে সুরমা নদীর ওপর দিয়ে লোভা নদী ঘুরে লোভাছড়া চা বাগান। কিন্তু সহজ পথ হচ্ছে দরবস্ত-চতুল হয়ে কানাইঘাট সদর। তাছাড়া গাজী বোরহানউদ্দিন সড়ক ধরে গাছবাড়ি হয়েও কানাইঘাট সদর পৌঁছানো যায়। যে ভাবেই জান লোভা নদীতে তো বেড়াবেনই। দেখবেন লোভাছড়া চা বাগান। লোভা নদী ও এর আশেপাশের সৌন্দর্য স্বর্গীয়। সারা বছরই এখানে বেড়ানো যায়। তবু বরষায় লোভা নদীর মজাই আলাদা। আর বৃষ্টির দিন হলে তো কথাই নেই। সে জন্য অক্টোবর পর্যন্ত লোভানদী ভ্রমন অসাধারন। লোভা নদী আর লোভা ছড়া চা বাগান বেড়াতে হলে একদিনই যথেষ্ট। সে জন্য সিলেট শহর থেকে আপনাকে সাতসকালে রওনা হতে হবে।

এখানে সবুজ পাহাড় আর লোভা নদীর অসাধারন স্বচ্ছ পানি একবার দেখলে বারবার যেতে ইচ্ছে করবে। সঙ্গে বাড়তি পাওনা লোভাছড়া চাবাগান ও বাগানের প্রাচীন ঝুলন্ত সেতুর সঙ্গে এখানকার খাসিয়া গ্রাম। বাস মাইক্রো বা সিএনজি চালিত অটোরিকসায় যেতে পারেন কানাইঘাট। তারপর নৌকায় ঘুড়ে বেড়াবেন মনোরম লোভায়। তারপর চাবাগান হয়ে ফিরতি পথ ধরা! কানাইঘাট বাজার ছাড়া খাবারের ভাল ব্যবস্থা নেই। নৌকায় উঠলেই পেটে টান ধরবে। সুতরাং সঙ্গে পর্যাপ্ত খাবার নিয়ে নেবেন!

ছবি : লেখক

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.