Sylhet Today 24 PRINT

রাতারগুল নয়, জুগিরকান্দি

আবদুল হাই আল-হাদী |  ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সন্ধ্যা আসার তখনো ঢের সময় বাকি। কিন্তু হিজল, বেত আর মূর্তার এ জলাবনে সন্ধ্যার আগমণী গান বেজে উঠেছে অনেক আগে। মনে হয় যেন এখানে প্রকৃতির সর্বজনীন নিয়মের ব্যতয় ঘটেছে। ডাহুক, কানাবক, ঘুঘু, মাছরাঙা আর নাম না জানা বিচিত্র সব পাখীদের কলরবে মুখরিত চারদিক। শিয়ালের হুক্কা হুয়া আওয়াজ সেটিকে করে তুলেছে আরও বেশি জীবন্ত। অগণিত হিজল গাছ কোমর পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় পাতার বিশাল ঝাঁপি নিয়ে ধ্যানী সাধকের মতো যেন পাহারা দিচ্ছে পুরো বনকে। ঘন ইকড় আর মূর্তাবন থেকে কিসের যেন ভেসে আসছে ছুটোছুটির শব্দ ।

সম্ভবত: শিয়াল, নেউল কিংবা উদ বা বনবিড়ালরা বেরিয়ে পড়ছে রাতের নেশায় । বনের ফাঁকের ছোট ছোট ফাড়িতে গজার, বোয়াল আর শুলমাছ শিকারীদের পাতানো ফাঁদ। ফাঁদের ব্যাঙ খেতে আসা এক কানাবক আটকা পড়ে চটপট করছে পানির মধ্যে । সন্ধ্যার আগেই এখানে নেমেছে রাত্রির আয়োজন। প্রকৃতির এরকম  বিচিত্র সব কারবার আর মনমাতানো সৌন্দর্য্যে দেখা মেলে  জুগিরকান্দি জলারবনে।

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত সারা দেশজুড়ে। জাফলং, বিছনাকান্দি, পাংথুমাই, আর রাতারগুলের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কথা কে না জানে! পর্যটকদের ভ্রমণের গন্তব্যস্থানের তালিকায় নতুন নাম  ’জুগিরকান্দি জলারবন’ যুক্ত হলো।  সিলেট-তামাবিল সড়ক দিয়ে প্রায় ৩৭ কি.মি. পর পশ্চিম দিকে চলে গেছে সারি-গোয়াইনঘাট সড়ক। সে সড়ক দিয়ে প্রায় ১০ কি.মি. গেলেই বেখরা ব্রিজ। সেখান থেকে বেখরা খাল দিয়ে ছোট ছোট নৌকাতে প্রায় দেড় কি.মি.উত্তরেই জুগিরকান্দির অবস্থান। প্রায় ১ হাজার একর আয়তনের এ জলারবন তাঁর রুপের মাধুরী আর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিজের অস্তিত্ব ধরে আছে।

প্রকৃতির এ অসাধারণ বনে চারদিকে কেবলই মনমাতানো সৌন্দর্য্য। প্রকৃতি তাঁর অকৃপণ হাতে সাজিয়েছে এ বনকে। চারদিকে অথৈ পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে হিজল, করচ, বরুণ, শেওড়া, জাম আর দেশী পানিবান্ধন নানা প্রজাতির গাছ। সে গাছগুলোর ঝোপজঙ্গলের নিবিড়তা অন্য যেকোন  বনভূমির চেয়ে বেশি। গাছের মধ্যে আবার হিজলের সংখ্যা লক্ষ্যণীয়ভাবে বেশি। মানুষের ছোঁয়া বহির্ভূত সেসব গাছ তাঁর আদি রুপ অনেকটাই ধরে রেখেছে। এসবের মাঝে আবার ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তা , ইকড় আর ছনের বন। সাপ, বিচ্চু আর পাখীদের এক নিরাপদ আশ্রয় এসব বন। পানির মধ্যে রয়েছে দেশীয় প্রজাতির নানা প্রকার মাছ। তাছাড়া উদবিড়াল, কচ্ছপ, গুইসাপসহ রয়েছে উভচর প্রাণী। বাতাসের ঢেউয়ে যখন পানি আচঁড়ে বনের উপর, তখন এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।  বনের মধ্যে নৌকায় করে গেলে মনে হবে- কোন দিক রেখে যে কোন দিকে তাকাবো! সামনে তাকালে মনে হয় পেছন দেখা দরকার, পেছনে তাকালে মনে হবে ডানপাশের বন মিস করছি! সত্যিই এক অপূর্ব অসাধারনত্ব নিয়ে বনটি নিজের আপনত্ব ধরে রেখেছে।  

গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ বনটি তথা জুগিরকান্দির মালিকানা রয়েছে অনতিদূরের তিনটি গ্রামের মানুষের । তবে মূলত: খমপুর গ্রামবাসীই এটি ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি। মিডিয়াতে না আসায় জলারবনটি এখনও পর্যটক ও বাইরের মানুষের কাছে অপরিচিত। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও স্থানীয় মানুষদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এটিকে আরও সমৃদ্ধ সোয়াম্প ফরেস্ট করা যেতে পারে। তবে কোনভাবেই যেন এটি মানুষের কাছে আকর্ষণীয় পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়ে তার নিজস্ব ইকোসিস্টেম ধবংসের কারণ হয়ে না দাঁড়ায় সেটির প্রতি সচেতন দৃষ্টি রাখা দরকার বলে সচেতন লোকজন আহবান জানিয়েছেন।

আবদুল হাই আল-হাদী, প্রধান সমন্বকারী, সেভ দ্য হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.