Sylhet Today 24 PRINT

হারিয়ে যেতে বসেছে সিলেটের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ‘ঢুপি মঠ’

আব্দুল হাই আল-হাদী |  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সিলেট কবির ভাষায়- ‘লক্ষ্মীর হাট, আনন্দের ধাম’ । প্রকৃতি তাঁর অকৃপণ হাতে নিজের মতো সাজিয়েছে এ জনপদকে। এখানকার রূপ-লাবণ্য আর মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা সর্বদাই দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে ছিল খুবই আকর্ষণীয়। তাই প্রাচীনকাল থেকে এ জনপদে ছুটে এসেছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য ওলী-আওলীয়া, পীর-দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসী আর কবি-সাহিত্যিক।

আদিগন্ত বিস্তৃত সমতলভূমি, উঁচু-নিচু পাহাড় আর হাওর-বাওর ও অগণিত জলাভূমির মিশ্রণ তৈরি করেছে মনোলোভা দৃশ্যের। এজন্য প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর জীবনকে দেখতে এখানে এসে থাকেন। প্রাণ ভরে উপভোগ করেন সৌন্দর্যকে। কিন্তু মানুষের লোভী হাতের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড আর যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত সেসব স্থান ক্রমেই তাঁর নিজস্বতা হারাতে বসেছে। সেজন্য আন্তর্জাতিক পর্যটন দিবসে সিলেটের পর্যটন বিকাশের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক দিকটির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

ঐতিহাসিকভাবে সিলেট একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে এ অঞ্চলে সভ্য মানুষের বিচরণ ছিল। সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে এখানকার মানচিত্রও ওলট-পালট হলেও সেসব মানুষদের কীর্তি-গাঁথা আজও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অযত্ন-অবহেলা আর সংরক্ষণের অভাবে প্রায় পরিত্যক্ত সেসব চিহ্নসমূহ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে আজও সোনালী অতীতের গৌরবগাঁথা প্রচার করছে। সেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও স্থাপনা যদি ঠিকভাবে সংরক্ষণ করে মানুষের কাছে প্রচার করা হয়, তবে প্রাকৃতিক স্থানসমূহের মতো সেখানেও পর্যটকদের ঢল নামবে। সিলেটে লোকচক্ষুর অন্তরালে প্রায় পরিত্যক্ত দু’শতাধিক বছর আগের এরকম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হচ্ছে ‘ঢুপি মঠ’।

‘ঢুপি মঠ’ কোথায়- সে প্রশ্ন যদি করে থাকেন, তবে তার সাদামাটা জবাব হচ্ছে সেটি আপনার অতি পরিচিত একটি স্থান। বিশেষ করে, সিলেট-তামাবিল সড়ক দিয়ে যারা জাফলং বা ভারত ভ্রমণ করেছেন, তাদের জন্য ‘ঢুপি মঠ’ চেনার ক্ষেত্রে খুব অসুবিধা হবেনা। সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩৭ কি.মি. দূরে রাস্তার মধ্যখানে প্রাচীন আমলের একটি দ্বি-চালা ঘর দাঁড়িয়ে আছে। সেটি চিনতে পারলেই ‘ঢুপি মঠ’র অবস্থান আপনি চিনতে পেরেছেন।

ঘরটিকে আপনি হয়তো চেনেন- রাজার ঘর, ইরা-দেবী ঘর, রাজধানীর একটি বর্ধিত ঘর ইত্যাদি নামে। রাস্তার মধ্যের এ ঘরটি মূলত: একটি ‘পান্থশালা’ যা কি না ‘ঢুপি মঠ’ এরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ।

ঢুপি মঠ তৈরির সময় রাজকীয় পূণ্যার্থী ও অন্যান্য অতিথিদের জন্য এ ‘পান্থশালা’ নির্মাণ করা হয়। সারিঘাটের পান্থশালার পূর্ব দিকে প্রায় একশ গজের মধ্যেই ঢুপি পাহাড় শুরু হয়ে পূর্ব দিকে চলে গেছে। সে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে ‘ঢুপি মঠ’ যা প্রায় ৪০০ মিটার উঁচুতে পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত।

পাহাড়ের উত্তরদিকে গা বেয়ে মোটামুটি একটি রাস্তা ঘুরে ক্রমশ: দক্ষিণমুখো হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। প্রবীণদের মতে, সে রাস্তাটি আগে খুবই সুন্দর পাথর নির্মিত ছিল এবং সেটিতে ১৮৯ টি পাথরের সিঁড়ি ছিল (স্থানীয়দের ভাষায় ‘ন’কুড়ি ৯ খান’ বলে পরিচিত)। স্থানীয়রা পুকুরঘাট বাঁধাই এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য সেসব পাথর নিয়ে গেছে। রাস্তাটির মাঝখানে যেখানে সেটি বাঁক নিয়ে আরো উপরের দিকে উঠে গেছে, সেখানে একটি কুপ ছিল। পথিকদের পিপাসা নিবারণের জন্য এটি নির্মিত হয়েছিল। বছর পাঁচেক আগেও এটিতে পানি পাওয়া যেত। অনেক কষ্টে দুর্গম পাহাড়ী পথ বেয়ে চূড়ায় উঠলে সত্যিই অভিভূত হতে হয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মানুষের অনাদর-অযত্নের পরও অনেক প্রাচীন নিদর্শন এখনও দাঁড়িয়ে আছে। চুড়ার পুরোটাই সমতল এবং সেখানেই পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যে তখনকার সময়ের সর্বাধিক আভিজাত্যের মিশেলে ‘রামেশ্বর মন্দির’ স্থাপন করা হয়েছিল।
প্রথমেই পূর্বদিকে মধ্যমাকৃতির একটি গেইট দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবত: এটি ছিল মঠে ঢুকার ঐচ্ছিক কোন গেইট। গেইটটি চুন-সুরকির তৈরি এবং জৈন্তিয়ার অন্যান্য প্রত্নসম্পদের সাথে এর স্থাপত্যশৈলীর পুরো মিল রয়েছে। সে গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকার পর দেখা যায়-গেইটের সাথে সংযুক্ত একটি ঘর রয়েছে যেটি এখন প্রায় পরিত্যক্ত এবং ঝোপ-জঙ্গলে আবৃত। ঘরটির দরজা পশ্চিম দিকে। স্থানীয়রা এটিকে ‘সতি-ময়নার’ ঘর হিসেবে ডেকে থাকে। সম্ভবত: এ ঘরে মন্দিরের পুরোহিত বসবাস করতেন কিংবা মন্দিরের অন্য কোন কাজে ঘরটি ব্যবহার করা হতো। পুরো মন্দিরটি সুউচ্চ মজবুত দেয়াল দ্বারা ঘেরা ছিল যার কিছুটা অংশ এখনও অক্ষত আছে। দক্ষিণের দেয়ালের মধ্যখানে রয়েছে একটি উঁচু গেইট যেটি পূর্বদিকের গেইটের চেয়ে অনেক বড়। গেইটের মধ্যে অনেক কারুকার্যখচিত আছে এবং এটিতে আভিজাত্যের প্রকাশ লক্ষণীয়। গেইটটি এখনও অবিকৃত আছে।

চুড়ার মধ্যখানে দু’গেইটের উত্তর-পূর্ব দিকে মঠের মূল ‘রামেশ্বর শিব’ মন্দির ঘরটি অবস্থিত। ঘরটির কারুকার্যখচিত ভিটা এখনও দেখা যায় এবং ধ্বংসাবশেষ চারপাশে স্তূপাকারে পড়ে আছে। ধ্বংসাবশেষের কাছেই রয়েছে পাকার বাঁধানো একটি পানির কুপ যা ‘ইন্দিরা’ নামে পরিচিত। সেটির কাঠামো অবিকৃত থাকলেও সেটি এখন পরিত্যক্ত। মন্দিরের ‘রামেশ্বর শিব’ নামক শিবমূর্তি এখানেই স্থাপিত ছিল। শিব মূর্তির নিকটে একটি পাথরের ষাঁড়ও রক্ষিত ছিল । ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মন্দিরের চুড়া ও বৃষটি বিচূর্ণিত হয়ে যায়। ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে সামান্য সংস্কার করলে সেটি এখনও পূণ্যার্থী ও দর্শকদের জন্য এক আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হতে পারে। ধ্বংসের আগে মন্দিরের চুড়া প্রায় ১০/১২ মাইল দূরে থেকেও দেখা যেত বলে ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন।

ঐতিহাসিকদের মতে, প্রায় ২১৬ বছর পূর্বে জৈন্তিয়ার রাজা লক্ষ্মী সিংহের মৃত্যুর পর রাজা বিজয় সিংহের ভাগনা রাজা দ্বিতীয় রাম সিংহ ১৭৯০ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি নিত্যানন্দ গোস্বামীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং ঢুপি পাহাড়ের প্রায় চারশত ফুট উচ্চতায় সুচারুশিল্প খচিত এক উচ্চ চুড়া বিশিষ্ট মন্দির নির্মাণ করেন। ১৭৯৮ সালে সেখানে ‘রামেশ্বর শিব’ নামক শিবমূর্তি স্থাপন করেন। রাজা রামসিংহ মঠস্থ ‘রামেশ্বর’ শিবের সেবা পরিচালনার জন্য ‘রোকড়পুরী’ সন্ন্যাসী নামক জনৈক সন্ন্যাসীকে সেবায়েত নিযুক্ত করে চৈলাখেল মৌজা হতে ১৯ হাল ভূমি দান করেন। এরপর পাঁচভাগ পরগনা হতে ১৮০৩ সালে আরো ১২৯ হাল ভূমি এ মঠের জন্য দান করেন।

অত:পর রাজা তাঁর দীক্ষাগুরু নিত্যানন্দ গোস্বামীর উপদেশে বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেন এবং ১৮০৬ সালে মঠের নিকট ডৌডিক গ্রামে ‘রাধা গোবিন্দের’ যুগলমূর্তি স্থাপন করে গোস্বামীকেই অর্চনা কাজে নিয়োজিত করেন। সেবা পরিচালনার জন্য রাজা চিকনাগুল হতে ৩৮ হাল জমি তাম্রলিপিতে লিখে দান করেন। তখন পর্যন্ত রাজা বড় গোসাইয়ের বিধবা পত্নী রাণী কাশাবতী জীবিত ছিলেন এবং তিনি রাধা-গোবিন্দের সেবার জন্য রামসিংহের সম্মতিক্রমে এ বছর বাজেরাজ পরগণার রাধানগর গ্রাম হতে পৌনে পঁচিশ হাল এবং ধর্নপুর মৌজা হতে বাসুদেব ও জগন্নাথের সেবার জন্য সাড়ে ২৮ হাল জমি দেবোত্তর হিসেবে দান করেন। রাজা দ্বিতীয় রাম সিংহ প্রায় ৪২ বছর অত্যন্ত নিরুদ্বেগে জৈন্তিয়া শাসন করেন এবং ১৮৩২সালের নভেম্বর মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রামেশ্বর শিব স্থাপন ও জমি দানের জন্য লিখিত সে সময়ের তিনটি তাম্রলিপি পাওয়া গেছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থানসমূহ সিলেটে পর্যটকদের প্রধান গন্তব্যস্থান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক কষ্ট করে তাঁরা সেসব স্থানে ভ্রমণ করে থাকেন। মানুষের অতিরিক্ত আনাগোনা আর কর্তৃপক্ষের অপর্যাপ্ত নজরদারিতে সেসব পর্যটন কেন্দ্রের সৌন্দর্য ক্রমেই ম্লান হতে চলেছে। ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ একটি জনপদ হিসেবে সিলেটের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের প্রতি গুরুত্বারোপ করা যেতে পারে। শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরান (রহ.) এর মাজার প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের উপস্থিতি এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

পর্যটন বিকাশের স্বার্থে প্রত্নতাত্ত্বিক সকল নিদর্শন বিশেষ করে ‘ঢুপি মঠ’এর সংরক্ষণে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।

আব্দুল হাই আল-হাদী : প্রধান নির্বাহী, সেভ দ্য হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.