Sylhet Today 24 PRINT

সিলেট থেকে চট্টগ্রামের পথে : কতিপয় ভোগান্তি ও কিছু অনুরোধ

রেজাউল আবেদীন |  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬

৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভুমি সিলেট এবং ১২ আউলিয়ার বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাথে আমার রয়েছে যেন আত্মার সম্পর্ক। প্রশ্ন হতে পারে, সেটা কেমন করে? তাই বলছি, পড়াশোনার সুবাদে আমি যখন রাজধানী ঢাকায় বসবাস করছিলাম, তখন ১৯৯৮ কি ১৯৯৯ সাল। আমার গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন হবার পর আমি আমার পরিবারের প্রধান আমার বাবা মারফৎ খবর পেলাম, চট্টগ্রামে উনার একজন বন্ধু রয়েছেন যিনি নোয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন।

বাবার কথা মতো আমি ও পরিবারের সবাই সিলেট থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা হই এবং চট্টগ্রামে পৌঁছে যথারীতি চাকুরীর ইন্টারভিউতে উত্তীর্ণ হয়ে জীবনের সর্বপ্রথম চাকুরীতে যোগ দেই 'ফার ইষ্ট শেয়ারস এন্ড সিকিউরিটিস লিঃ' নামক প্রতিষ্ঠানে, যা বর্তমানে আগ্রাবাদে অবস্থিত। তারপর চট্টগ্রামে দীর্ঘ সাড়ে ৯ বছরের পথচলা শুরু হয়। আর এই অব্যাহত যাত্রা এখনও চলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর সুবাদে দেশে ও বিদেশে।

১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৬ সালের সুদীর্ঘ ১৭ বছর সময় পরিক্রমায় আমার নিজ দৃষ্টিতে যে যে অসংগতি পরিলক্ষিত হয়েছে, তার একটি সারসংক্ষেপ আলোচনার প্রয়াস নিচ্ছি মাত্র। এখান থেকে সম্ভাব্য যাত্রীরা একটি আগাম বার্তা পাবেন। আর সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ এসব ব্যাপারে উন্নতিকল্পে সূদৃষ্টি দিলে সমস্যাগুলোর আশু সমাধান হবে বলে মনে করছি।

১। পর্যটকদের জন্য সিলেট ও চট্টগ্রাম নগরী দুটি লোভনীয় স্থানঃ  সিলেটে রয়েছে বিছনাকান্দি (গোয়াইনঘাট), লোভাছড়া, জাফলং, রাতারগুল, এয়ারপোর্ট এলাকার চা-বাগানসমুহ, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান (সাতছড়ি ন্যাশনাল পার্ক/সাতছড়ি রিজার্ভ ফরেস্ট) প্রভৃতি। অন্যদিকে চট্টগ্রামে রয়েছে বেশকয়েকটি দর্শনীয় স্থান। যেমন- পতেঙ্গা সী বীচ, ফয়েস লেক, ওয়ার সিমেট্রি (খীস্ট্রান যোদ্ধাদের কবর/সমাধিস্থল), নতুন কর্ণফুলী সেতু, কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রভৃতি। এছাড়াও রয়েছে কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি। সেন্টমার্টিন (টেকনাফ থেকে নাফ নদ হয়ে যেতে হয়), সেসব জায়গায় পোঁছাতে হলে আপনাকে চট্টগ্রাম থেকে আরো ৪-৫ ঘণ্টা বাসে বা ভাড়াকৃত গাড়িতে করে যেতে হবে। সেসব স্থানে পরিবারসহ বা বন্ধু-বান্ধবসহ বেড়ানোই উত্তম। যাবার জন্য আগে ভাগেই হোটেল বুকিং দিয়ে গেলে খুব ভাল হবে।

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে রয়েছে সাগরের লোভনীয় মাছ, যেমন- রূপচাঁদা, কোরাল, লইট্টা, ইলিশ, সুরমা, চিংড়ি, পোয়া, কাঁকড়া। ফ্রাই/ভাঁজা করে খাওয়ার জন্য অতি সুস্বাদু মাছ হচ্ছে- রূপচাঁদা, চিংড়ি, কোরাল, ইলিশ ও কাঁকড়া।

২। সিলেট থেকে চট্টগ্রাম একটি দীর্ঘ যাত্রাপথঃ  এ রুটে ট্রেনে চলাচলে ব্যয় হয় আনুমানিক ১০ ঘণ্টা থেকে সাড়ে ১০ ঘণ্টা সময়। আছে আন্তনগর ট্রেন 'পাহাড়িকা' ও 'উদয়ন এক্সপ্রেস', যা যথাক্রমে সকালে ও রাতে সিলেট ষ্টেশন হতে ছেড়ে যায় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।

৩। বাসে চলাচলঃ সিলেট থেকে চট্টগ্রামে চলাচলের জন্য কিছু কিছু বাস কর্তৃপক্ষ এ রুটে চলাচলের জন্য বাস চালু করেছেন। পরিবহনসমূহ হল- মামুন পরিবহন, সৌদিয়া, এনা পরিবহন এবং গ্রীণ লাইন। ভাড়া পড়বে যথাক্রমে ৬৫০ টাকা থেকে ১৩০০ টাকা পর্যন্ত। পৌঁছাতে সময় লাগবে আনুমানিক ৮ ঘণ্টা থেকে ৯ ঘণ্টা।

৪। বিমানে চলাচলঃ সিলেট থেকে চট্টগ্রাম দীর্ঘ যাত্রাপথ হওয়া স্বত্তেও কোনও বিমান যাত্রার ব্যবস্থা নেই। এটা খুবই উদ্বেগের ব্যাপার বটে। বাংলাদেশের প্রাইভেট বিমান কর্তৃপক্ষ চাইলে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম থেকে সিলেট রুটে ফ্লাইট চালু করে মুনাফা অর্জন করতে পারে। কারন এ রুটে রয়েছে বিমানে চলাচলের গ্যাপ। আর দেশী ও বিদেশী পর্যটকরা এই দুইটি শহরকে বেশ কাছে মনে করে বিমানে পথ চলাচল শুরু করে দিতে পারে অনায়াসে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন মানেই হচ্ছে ব্যক্তি জীবন তথা ব্যবসা-বানিজ্য প্রসারে ও দেশজ অর্থনৈতিক পরিসরে উন্নয়ন ঘটানোয় অবদান রাখা।

৫। সিলেট থেকে চট্টগ্রাম রুটে সরাসরি বিরতিহীন ট্রেনের অভাববোধঃ এক সিটে বসে ১০ থেকে সাড়ে ১০ ঘণ্টা সময় ভ্রমন করা আসলে চাট্টিখানি কথা নয়, বরং বিরক্তিকর। আপনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার রুটের গাড়িগুলোর সাথে তুলনা করলে দেখবেন, সেখানে রয়েছে সুবর্ণ এক্সপ্রেস এর মতো ট্রেন যেটা মাঝখানে মাত্র একটি ষ্টেশনেই (বিমান বন্দর স্টেশন) থামে। আর সেই রুটে অন্যান্য ট্রেনগুলোও বিশেষ কোন কারন ছাড়া দেরী করে ছাড়ে না। কিন্তু সিলেট থেকে চট্রগ্রাম বা চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের উদ্দ্যেশে ছেড়ে আসা ট্রেনগুলো মাঝে মাঝে দেরি করে ছাড়ে, যা চরম বিরক্তিকর। আমরা পরিবারসহ সর্বশেষ পাহাড়িকা ট্রেনে ভ্রমণ করেছি গত ডিসেম্বরের ৬ তারিখে। সেই ট্রেনটি ২ ঘণ্টারও বেশি দেরি করে স্টেশন ছেড়েছিল। এসব ভোগান্তি বিবেচনায় নিয়ে আমরা সরাসরি বিরতিহীন ট্রেন চালুর দাবি করতেই পারি। বিরতিহীন ট্রেন চালু হলে যাত্রীরা ১০ ঘণ্টার স্থলে ৭ থেকে সাড়ে ৭ ঘন্টায় গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবেন বলে মনে করছি।

৬। আন্তঃনগর ট্রেনে বিক্রয়কৃত খাবার সরবরাহের মানঃ আমার নিজের দেখা, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম যাবার পথে ওয়েটারগন পরপর দু'বার বাসি খাবার একাধিক যাত্রীর কাছে পরিবেশন করেছেন। আর সেই খাবারে এক বা দুই কামড় দেয়ার পরে ক্রেতা যাত্রীরা বিক্রেতার সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছেন। বেশ তর্কযুদ্ধ শেষে বিক্রেতা শুধু ক্রয়কৃত ১ পিসের দামই দিয়েছেন, কিন্তু তারা দাবি করেছিলেন পুরো ৩ পিসের দাম। আর ক্রেতারা বারবার তাদেরকে অনুরোধ করেছিলেন, সরবরাহকৃত খাবার পাল্টে টাটকা খাবার দেয়ার জন্য! ১ প্লেট ৫০ টাকা শুনে আবার মনে করবেন না যেন ৩ পিসের দাম ৫০ টাকা। আপনি ১ প্লেট ৩ পিসওয়ালা পাবেন। আর দাম গুনতে হতে পারে ১৫০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা।

মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার পরিবেশনার কারণে একদিকে যেমন স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রাণ হারাণোর ভয়। আমরা অনেক সময় খবর শুনি যে, খাবারের বিষক্রিয়ার অমুক স্থানে ৩০-৩৫ লোকের প্রাণহানী হয়েছে বা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে এবং হসপিটালে চিকিৎসাধীন। সাবধানবানী ও পরামর্শ হচ্ছে, খাবারের মান ভাল দেখে পরিবেশন করুন। পচা ও বাসি খাবার বিক্রি করে মানুষ ঠকাবেন না।

৭। জনসচেতনতা বৃদ্ধিকরনঃ আন্তঃনগর ট্রেনে বা বাসে চলাচলের সময় আপনার পাশের জানালা বন্ধ রাখবেন। কারন দুষ্ট বাচ্চারা পাশ থেকে চলন্ত অবস্থায় জানালা দিয়ে ঢিল ছুঁড়তে পারে অথবা ঝাঁপটাবাজ চোরেরা আপনার মূল্যবান সামগ্রী, যেমন– স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ, ভ্যানিটি ব্যাগ, পার্স, টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিতে পারে আপনাকে সচেতন রেখে বা অচেতন করে। আর আপনার মূল্যবান জিনিসপত্রসহ কোন ব্যাগ যদি সাথে থাকে, তাহলে তা গাড়ির সিটে ফেলে রেখে যাবেন না। অপরিচিত কারো দেয়া কোন কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন । এ ব্যাপারে নিজেরা সচেতন হোন আর আপনার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের এসব ব্যাপারে অবগত করুন। সাবধানের মার নেই। অসাবধানতাই যেকোন দুর্ঘটনার জন্য মূলত দায়ী।

৮। হামদ নাত, আধুনিক সঙ্গীত পরিবেশনা ও সতর্কবানী প্রচারঃ ১৯৯৯ সালে থেকে আনুমানিক ২০১০ সাল অবধি দেখে এসেছি, ট্রেন ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে কবি নজরুলের হামদ ও নাত, গজল পরিবেশনা হতো, ট্রেন ছাড়ার সময়ে শোনা যেত, আধুনিক শ্রুতিমধুর গান পরিবেশনা হতো, সময়ে সময়ে সতর্কীকরণবানীও মাইক্রোফোনে ভেসে আসতো। আপনি কোন ষ্টেশনে কিছুক্ষন পর পৌঁছুবেন, কোন স্টেশন ছেড়ে এলেন প্রভৃতির ঘোষণা থাকতো। আর এখন সেগুলো নেই। কেবলই আছে স্মৃতির পাতায় অতীত হয়ে!

৯। আসনের মানের দুরবস্থাঃ  পাহাড়িকা ট্রেনের কম-বেশি সব বগিতেই আসনের, বিশেষ করে শোভন চেয়ারের আসনগুলোর দুরবস্থা দেখে হতাশ হয়েছি। একে তো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, অন্যদিকে ভাঙা আর জোড়াতালি দেয়া সিটে বসে যেতে হবে। কিছু কিছু সিট অটো স্লিপিং মোডে দেয়া, কারন এর বিকল্প নেই! ফলে সিট নিয়ে যাত্রীতে যাত্রীদের আছে ভীষণ অসন্তোষ। ভাড়া কিন্তু কম কেউই নিচ্ছে না। কারন আপনি টিকেট তো আগে থেকেই কিনে ফেলেছেন!

১০। জ্যাম বা যানজটের শহরে রূপান্তরিত হচ্ছে প্রিয় বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ভিতরের পথঃ আমি প্রথমেই বলেছি, আমার ক্যারিয়ার ও পড়াশোনার একটি বৃহৎ সময় কেটেছে চট্টগ্রামে। সেটা আনুমানিক সাড়ে ৯ বছর। যত দিন যাচ্ছে, মানুষ শহরমুখী হচ্ছে, ব্যবসার প্রসার বাড়াচ্ছে, যানবাহন কিনছে। ফলে যানজটও দিনকে দিন শহরের ভিতরে বাড়ছে। আপনার যদি কোন মিটিং বা ব্যবসায়িক কোন অ্যাপয়েনমেন্ট থাকে, তাহলে হাতে অতিরিক্ত কিছুটা সময় নিয়ে বের হোন। তাতে আপনার ইজ্জতও বাঁচবে, হতাশও হবেন না।

পরিশেষে, পাঠকবৃন্দের শুভ যাত্রা ও সুখকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার জন্য শুভ কামনা রইল। আর কর্তৃপক্ষের নিকট আকুল নিবেদন রইল, ট্রেনের মানের উন্নতিকল্পে যথারীতি সুষ্ঠু পদক্ষেপ নেয়ার।

 

লেখক : সিইও এন্ড কন্সালটেন্ট, থটওয়ার্স কন্সালটিং এন্ড মাল্টি সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল এবং সহকারী পরিচালক (অর্থ), নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, সিলেট।

 

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.