তায়রান রাজ্জাক | ০৮ জুন, ২০১৭
যদিও সময়টা ছিল ২০১৫ এর বর্ষাকাল। এতদিন পরে লেখাটা দিতে ইচ্ছে করল যখন হাওরের কান্না ভাসছে সুনামগঞ্জের বাতাসে বাতাসে। আমার এত ভালোলাগার, ভালোবাসার হাওরের সুখস্মৃতি গুলো ফিরে আসছিল বার বার। সেই স্মৃতিগুলো ভাগ করতে ইচ্ছে করল সবার সাথে। তাই এই লেখা। হাওর আর হাওর-বাসী আবার আগের সেই সুন্দর দিনগুলোতে ফিরে যাবে খুব তাড়াতাড়ি, এই প্রার্থনা আমার।
ভরা বর্ষায় ভর পূর্ণিমায় আমরা ১২ জন রাতের গাড়িতে রওনা দিলাম সুনামগঞ্জ। ট্যুর এর আনন্দ আতিশয্যে ঘুম এলো না কারোরই। আমাদের আড্ডা হৈ চৈ এ বাসের অন্য যাত্রীদের ঘুম ও পালাল সম্ভবত। ভাগ্যিস কেউ ঝাড়ি দেয়নি। বোধহয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখে। অবশ্য শেষ রাতে কখন যেন সবাই নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ল। ভোরবেলা মুখে পানির ছিটা লেগে ঘুম ভাঙল আমার। দেখি বাসের জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানি আসছে। বাইরে তাকাতেই দেখি যতদূরে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। একি! চলে এলাম নাকি টাঙ্গুয়ার হাওর? ধাক্কা দিয়ে জাগালাম পাশের জনকে। শুনলাম না আমরা সুনামগঞ্জ এসেছি, আর এরকম হাওর আছে এখানে অনেক। বৃষ্টি ভেজা সতেজ প্রকৃতি চোখ জুড়িয়ে দিল। সুনামগঞ্জে পৌঁছে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা করে রওনা দিলাম তাহিরপুর। যতই তাহিরপুরের দিকে যাচ্ছিল ততই দূরের পাহাড় একটু একটু করে যেন আমাদের তার কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। মেঘালয়ের এই পাহাড়গুলো সিমান্তের ওপারে হলেও তার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় এপার থেকেই। তাহিরপুর বাজারের ঘাট থেকে নৌকায় উঠলাম আমরা। পরিচিত একজনের কাছ থেকে আগে থেকেই নৌকা ভাড়া করা ছিল আমাদের। আগামী দুই দিন এই নৌকাই আমাদের ঠিকানা। বাজার থেকেই কেনা হল হাওরের তাজা বিশাল সাইজের বোয়াল মাছ।
বর্ষার কালচে জল কেটে নৌকা যতই এগোচ্ছিল ততই অবাক হচ্ছিলাম হাওরের ভয়ানক সৌন্দর্য দেখে। সত্যিই ভয়ানক সুন্দর লেগেছ আমার কাছে। এখানে আসার আগে হাওর সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিল না আমার। ভেবেছিলাম বিলের মতই বুঝি। কিন্তু ভুল ভাঙল এর বিশালতা দেখে। একবার মনে হল যেন সমুদ্র। আবার মনে হল নাহ এই ঢেউ, স্রোত চেনা নয় একদম অন্যরকম। এমনরকম যে শুধু টানতেই থাকে। মনে হয় হাওরের জলে যাদু আছে। সেই জাদুতেই বুঝি শাহ আব্দুল করিম বাঁধতেন গান, বাঁকা নয়নের নেশায় ডুবে যেতেন হাসন রাজা।
বৃষ্টিতে নৌকার বাইরে থাকা সম্ভব হল না বেশিক্ষণ। নৌকার ভেতর দোতারা, ইউকেলেলে, খমক, ইমরানের গান আর বাইরে বৃষ্টির রিমঝিম একটানা সুর। আহা,মনে হচ্ছিল অনন্ত কাল যেন ভাসতে থাকি হাওরে। দুপুরে মাঝিদের হাতের বোয়াল রান্না মনে হল অমৃত। এরপর গেলাম গারো পাড়ায়। সেখানকার মানুষের আতিথেয়তা মন কেড়ে নিল। ফিরে এলাম সন্ধ্যার আগেই। হাওরের রাত যেন মহাকাল। মেঘে ঢাকা আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের দেখা পেলাম যখন তখন যেন আনন্দে হাওরের জল ঝিকমিক করে উঠল। ঢেউয়ে দুলতে দুলতে গল্প করতে লাগল তারার সারি। বাউলগানের সাথে সেই ক্ষণে হাওরকে জীবনানন্দের ভাষায় মায়াবীপারের দেশ মনে হচ্ছিল।
‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ প্রবাদের সার্থকতা হাওরে পুরোপুরিই ব্যর্থ। হাওরে ভ্রমণ করবেন আর পানিতে নামবেন না তাহলে ধরে নেন আপনি ট্যুর এর ছয় আনা মিস করলেন। তাই পরদিন ওয়াচ টাওয়ারে নৌকা বেঁধে আমরা ঝাপ দিলাম হাওরের বুকে। লাইফ জ্যাকেট ছিল অবশ্যই। আকাশের রং চুরি করে নেয়া হাওরের নীল জলে ভেসে থাকতে থাকতে মনে হতে পারে জীবন সত্যিই সুন্দর। গেলাম যাদুকাটা নদীতে। হাওর কিভাবে নদীতে মিশেছে পারলে খুঁজে দেখতে পারেন সেখানে। জাদুকাটার জাদু কাটিয়ে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা। মাঝ হাওরে নৌকা বেঁধে শেষবারের মত গানের আসরে বসলাম আমরা। লাল হয়ে আসা সন্ধ্যার আকাশের কিনারে শান্ত হাওর । সাথে ফিরে আসার মন খারাপ হওয়া পরিবেশ। ‘তুমি জানোনারে প্রিয় দারুণ প্রেমের অপর নাম বেদনা…. মাঝির গান আমাদের মুহূর্তে কোথায় যেন নিয়ে গেল। প্রথমে চমকে গিয়েছিলাম প্রণয় মাঝি যখন গান ধরল। ভাটির দেশের মানুষের গলায় গান,সুর না থাকাটাই অস্বাভাবিক ভুলেই গেছিলাম। এরপর সেই সন্ধ্যাকে, হাওরকে, ঢেউকে পেছনে ফেলে আমরা ফিরে আসি কংক্রিটের জঙ্গলে।