Sylhet Today 24 PRINT

জাদুকাটা পেরিয়ে শিমুল বনে

তপন কুমার দাস, তাহিরপুর থেকে ফিরে |  ০৬ মার্চ, ২০১৮

বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত, মরমী কবি হাসন রাজা, দূরবীন শাহ ও বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জেলা সুনামগঞ্জ। প্রকৃতির নানা ছোঁয়ায় ভরপুর এই জেলাটিতে যাওয়ার ইচ্ছে অনেক দিনের। যখন শুনলাম জেলার ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা তাহিরপুরের শিমুল বাগানের কথা। ইচ্ছের মাত্রাটা তখন আরো বেড়ে গেল দ্বিগুণ। তাই আর দেরি না করে শিমুল বাগানে যেতেই মনস্থির করি।

শুধু মনস্থিরেই আর আটকে থাকিনি। যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই। ফোন করলাম আমার অসম্ভব ভালো লাগার মানুষ সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয় দাদা সমীর বিশ্বাসকে। ফোন রিসিভ করে দাদা ভালোমন্দ খবর নেওয়ার পর জানতে চাইলেন কবে যাচ্ছি। জানালাম ২৪ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ আসছি। এরপর দাদা যা বললেন, তাতে যেন আমার যাত্রার পায়ে ঘুঙুর বাজলো। দাদা বললেন, ‘এ দিন আমি সিলেটে মিটিংয়ে আসব। সিলেট থেকে এক সাথে যাব।’

২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে হঠাৎ বছরের প্রথম বৃষ্টি নামল। পরদিন সুনামগঞ্জ যেতে পারব কিনা এই ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

অবশ্য রাতের বৃষ্টি হলেও দিনের আবহাওয়া ভালো ছিল। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে বড়লেখা থেকে রওয়ানা দিলাম সিলেটের পথে। দুপুর দুইটায় পৌঁছলাম সিলেট শহরে। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে হাজির সিলেটটুডে অফিসে। অফিসে বাপন দাদার (দেবকল্যাণ ধর বাপন) সাথে আড্ডা আর কিছু নিউজের কাজ সেড়ে নিলাম।

সন্ধ্যার দিকে সমীর দাদার সাথে ফোনে কথা হল। দাদা তখন সুনামগঞ্জে যাওয়ার সময় জানালেন। এর মধ্যে প্রিয় দাদা সাংবাদিক দেবাশীষ দেবু ও শুভ ধর অফিসে হাজির। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিস থেকে বের হলাম। ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যা পৌনে ৭টা। শহরের টুকটাক কাজ শেষ করে দাদার আগে থেকে বলে রাখা নির্দিষ্ট স্থানে হাজির হলাম।

তখন রাত আনুমানিক ৮টা হবে। এরপর দাদাসহ তাঁর গাড়িতে করে যাত্রা করলাম সুনামগঞ্জের পথে। রাত সাড়ে ১০টায় পৌঁছালাম বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় দাদার বাসায়। তখন বেশ ক্লান্ত লাগছিল। ফ্রেশ হয়ে দাদার সাথে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। আগের রাতে ঘুম হয়নি ঠিক মত। সকালে শিমুল বাগান যাব, তাই তর যেন আর সইছিল না। ভেতরে যেন অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছিল। এ রাতে আবারও বৃষ্টি হয়। তবে ভালো ঘুম হয়েছিল। অবশ্য ভোর রাতে ঘুম ভেঙে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে দাদা আর আমি নাস্তা সারলাম।

প্রশাসনিক মিটিং থাকায় দাদা জেলা সদরে যাবেন। এর আগে তাহিরপুরের শিমুল বাগানসহ প্রাকৃতিক স্থানগুলো দেখার সব ব্যবস্থা আমার জন্য করে রাখেন দাদা। সাড়ে ৯টায় তিনি জেলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলেন। আর আমি তাহিরপুরের শিমুল বনের দিকে ছুটলাম।

দিনভর ঘোরাঘুরির জন্য তখন আমার সঙ্গী হলেন টাইগার মাসুদ জীবন। নামের আগে টাইগার রাখার কারণ হিসেবে জানালেন, সাহসের সাথে দুর্গম পথে গাড়ি চালানোর কারণে এলাকার অনেকে তাকে টাইগার মাসুদ নামেই ডাকেন। এসব এলাকায় সড়ক পথ ভালো না হওয়ায় লোকজনের যাতায়াতের একমাত্র ভরসা মোটরসাইকেল, ব্যাটারি চালিত টমটম, লেগুনা ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা।

তখন সকাল সাড়ে ১০টা। তাহিরপুর যাওয়ার পথে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার স্থানীয় নতুন বাজারে চা বিরতি। টাইগার মাসুদকে সাথে নিয়ে চা পানের জন্য একটি টং দোকানে গেলাম। চা পানের ফাঁকে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সাথে কথা বলে জেনে নিলাম এলাকার মানুষের জীবন জীবিকার কথা। তাদের কথা শুনতে শুনতে চা পান শেষ। এবার তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।

ভাঙা রাস্তা, ধুলা মাড়িয়ে আমাদের মোটরসাইকেল সামনে চলছে। আগের রাতে বৃষ্টি হওয়ায় গাছগুলোর পত্র পল্লবে যেন প্রাণ ফিরেছে। পাতা থেকে ধুলো সরে সবুজ ফিরেছে। চারপাশের সৌন্দর্য দেখে মোটর সাইকেল থামিয়ে কয়েকটি স্থানের ছবি তোললাম।

পনের বিশ মিনিট মোটরসাইকেলে চলার পর পৌঁছলাম তাহিরপুরে। দেখা মিলল জাদুকাটা নদীর। জাদুকাটার বুক চিরে তখন চলছে পাথর আর বালু উত্তোলন। ওখানকার মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র উৎস এ নদী। নদী তীরের পূর্বপাশে মাসুদ জীবন মোটর সাইকেল বন্ধ করলেন। শিমুল বনে যাওয়ার আগে শ্রী শ্রী অদ্বৈত প্রভুর আশ্রম ও শাহ্‌ আরেফীন টিলা দেখালেন। শাহ্‌ আরেফীন টিলা ঘুরে বিজিবি ক্যাম্পের পাশ দিয়েই আবারও জাদুকাটা তীরে পৌঁছলাম। বারিক টিলা আর শিমুল বাগান যেতে হলে জাদুকাটা নদী পাড়ি দিতে হয়।

ধুলা উড়িয়ে তখন ধুঁ ধুঁ বালুচরে চলছিল পাথর ও বালুবাহী ট্রাক্টর। বালুর রাস্তায় ঝুঁকিতে যাত্রী নিয়ে নদী ঘাটে পোঁছাচ্ছে মোটরসাইকেল। কেউ নৌকায় নদী পার হচ্ছেন। কেউ আবার নৌকা করে মোটরসাইকেলসহ পার হচ্ছেন।

দূর থেকে দেখা গেল অপরূপ জাদুকাটা নদীর তীরের লাল টকটকে শিমুল বন। যেন আগুন লেগেছে বনে। তবে পথ তখনও বেশ দূরের। মোটরসাইকেলে পাড়ি দিতে হবে জাদুকাটা নদী। নদীতে পানি কম, যতদূর চোখ যায় ধু ধু বালুচর। প্রখর রোদ।

মোটরসাইকেল থেকে নেমে বালুচরের মধ্যে হাঁটছি। হঠাৎ চোখ আটকে গেল নদী পারের পাথর ও বালু কোয়ারিতে। যেখানে কাজ করছে ছোট ছোট শিশুরা। যারা কঠিন-রুক্ষ এক জীবনে শৈশবেই পা রেখেছে। দেরি না করে মোটরসাইকেল থেকে নেমে দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দী করলাম।

তখন দুপুর দুইটা। জাদুকাটা নদী পার হয়ে পৌঁছালাম ওপাশের সবুজ বারিক টিলায়। তারপর কুয়াশায় মোড়ানো মেঘালয় পাহাড়। সবুজ এ পাহাড়ের বুক চিড়ে চলা নীল নদীটি বর্ষায় প্রাণ ফিরে পায়। তখন জাদুকাটা নদীর অপরূপ দৃশ্য দেখতে পর্যটকেরা ভিড় করেন।

বারিক টিলা থেকে নিচের দৃশ্যটি আরো মুগ্ধকর। ধূসর ছোটবড় ঢেউ ওঠা বালুর প্রান্তর। সারি সারি নৌকা। নদীর টলটলে জল। শিল্পীর তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে ফুটে ওঠা ছবির মতোই। কেবল মুগ্ধতা বাড়ে।

টিলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে যে কেউ বিমোহিত হবে। বারিক টিলা থেকে রওনা করে আনুমানিক আড়াইটায় পৌঁছলাম শিমুল বাগানে। সারি সারি শিমুল গাছে আগুনের ছোঁয়া। আগুন যেন হাওয়ায় ভাসছে। টকটকে লাল শিমুল ফুলে ছেয়ে গেছে পুরো বাগান। ওখানে আগুনের শিমুল ফুল দেখে মনটাই জুড়িয়ে গেল! ডালে ডালে খুনসুটিতে ব্যস্ত পাখিরা। এসব দৃশ্য দেখে যাত্রাপথের সমস্ত ক্লান্তি নিমিষেই উধাও।

জাদুকাটা নদী তীর ঘেঁষে ভারতীয় সীমান্ত লাগোয়া টিলাভূমি। এর নাম লাউড়েরগড়। লাউড়েরগড়ের এই বিশাল শিমুল বাগানটি পর্যটকদের কাছে এখন নতুন আকর্ষণ। এই এলাকাজুড়ে টকটকে লাল শিমুল ফুল গাইছে বসন্তের জয়গান। প্রতিদিন শিমুলের রক্তরাঙা সৌন্দর্য দেখতে অসংখ্য পর্যটক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হন এখানে। এই দিনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। একপাশে মরুপ্রায় জাদুকাটার বালুর চর পেরিয়ে বারিক টিলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য। অন্যপাশে লাল ফুলের এই বাগান চোখ আটকে থাকে। ইচ্ছে করে আরো কিছুটা সময়, আরো কিছুটা ক্ষণ এখানে কাটুক। প্রকৃতি এখানে আপন সত্ত্বায় উদার।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেল, ২০০২ সালে টাঙ্গুয়ার হাওর তীরবর্তী লাউড়েরগড় গ্রামে বাণিজ্যিক এই শিমুলের বাগান গড়ে তোলেন বাদাঘাট (উত্তর) ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন। তার পরিচর্যায় বেড়ে ওঠে দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান। ২ হাজার ৪০০ শতক জমিতে এই শিমুল বাগান গড়ে তোলেন তিনি। ফাগুনের শুরুতেই হাজার দু'য়েক গাছে যখন একই সাথে ফুল ফোটে তখন অসাধারণ এক দৃশ্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। শিমুল বনের রক্তরাঙা সৌন্দর্যের দেখা মেলে বছরে এই একটি ঋতুতেই। মধু আহরণের টানে ছুটে আসে হরেক রকমের পাখপাখালি। বাগানমালিক জয়নাল আবেদীন প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু রয়ে গেছে তার বাগানটি। এখন তার বড় ছেলে সাবেক চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে শিমুল গাছের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো হয়েছে লেবু গাছ, এতে বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। শিমুল বনের মায়া ছেড়ে এবার ফেরার পালা। টাইগার মাসুদ মোটরসাইকেল চালিয়ে নিয়ে গেলেন তাহিরপুরের আরেক পর্যটন স্পট ‘শহীদ সিরাজ লেকে’। যদিও এর পরিচিতি নিলাদ্রী নামে। শহীদ সিরাজ লেকে যাবার আগে খাবার পর্ব সেরে নিলাম স্থানীয় বড়ছড়া বাজারে। বাজার থেকে অন্তত ২০০ গজ ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। শহীদ সিরাজ লেকসহ দর্শনীয় আরো কয়েকটি স্থান দেখা শেষ।

সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলেছে। বাসায় ফিরতে হবে। তাহিরপুরের বালিয়া ঘাট নতুন বাজার হয়ে বিশ্বম্ভরপুরের দিকে রওনা দিলাম। জাদুকাট নদী পৌঁছাবার আগেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমরা দুজন নৌকায় নদী পাড়ি দিচ্ছি। এই সময় দূর থেকে ভেসে আসল বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ‘কেন পীরিতি বাড়াইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি’ গানের সুর। কতরকমের প্রেম জগতকে কাছের করেছে। প্রকৃতির অংশ বলেই কিনা মানুষ সেই প্রকৃতির কাছেই বারবার ছুটে যায়।

যেভাবে যাবেন
‘ঢাকা থেকে বাসে করে যান সুনামগঞ্জ। অথবা ট্রেনে যেতে চাইলে প্রথমে ট্রেনে করে সিলেট যেতে হবে সেখান থেকে বাস অথবা গাড়ি ভাড়া করে সুনামগঞ্জ শহরে। সুনামগঞ্জের আব্দুস জহুর সেতুর গোঁড়া থেকে বাইক অথবা লেগুনায় সরাসরি লাউড়ের গড় চলে যেতে পারবেন। বাইকে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা ও লেগুনায় ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা রিজার্ভ। চাইলে প্রাইভেট গাড়ি নিয়েও চলে যেতে পারেন লাউড়ের গড়। তারপর বালু চর দিয়ে হেঁটে চলে যান শিমুলবন।’

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.