Sylhet Today 24 PRINT

নিঝুম দ্বীপের আদ্যোপান্ত

সুফি আহমাদ ইশতিয়াক

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে জেগে উঠেছে চির সবুজের দ্বীপ নিঝুমদ্বীপ। |  ০৯ জুলাই, ২০১৫

নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক সম্পদ আর অপার সম্ভাবনায় সমৃদ্ধ নিঝুমদ্বীপ। আয়তনে খুব বড় না হলেও প্রকৃতি তার নিজ হাতে অপরূপ সাজে সাজিয়েছে দ্বীপটিকে। জোয়ার-ভাটার এই দ্বীপের এক পাশ ঢেকে আছে সাদা বালুতে, অন্য পাশে সৈকত। খোলা মাঠ, বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ যেন দিগন্তে গিয়ে মিশে গেছে। চোখ জুড়ানো নকশিকাঁথার মতো বিছিয়ে থাকা সবুজ ঘাসের ওপর হরিণের ছোটাছুটি দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এই বনে সরকারি হিসাবে প্রায় ৪০ হাজারের মতো হরিণ আছে।

জানা যায়, ১৯৭৮ সালে এ দ্বীপের কেওড়া বনে ছেড়ে দেয়া হয় চার জোড়া চিত্রা হরিণ। তার থেকেই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে হরিণের সংখ্যা। মায়াবী হরিণের পাল যে রঙ-তুলিতে আঁকা শিল্পীর হাতের ছবি। দ্বীপের বন ও ফসলের মাঠে ঘুরে বেড়ায় হরিণের দল। শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত হাজার হাজার পাখির কারণে এখানে রীতিমতো পাখির মেলা বসে যায়, পুরো দ্বীপ তখন পাখির রাজ্যে পরিণত হয়। অন্যান্য সময় বনের কিচিরমিচির পাখির শব্দ, আর ভেসে আসা বাতাসে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইবেন প্রকৃতির মাঝে। সাদা বালুতে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়ার বিচরণ। যে সাদা ক্যানভাসে আঁকা প্রকৃতির অপূর্ব এক ছবি। নিঝুমদ্বীপ একটি ছোট্ট দ্বীপ। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত নিঝুমদ্বীপ। এক দিকে মেঘনা নদী আর তিন দিকে বঙ্গোপসাগর ঘিরে রেখেছে। নিঝুমদ্বীপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো মাইলের পর মাইল জুড়ে কেওড়া বন আর সেই বনের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা চিত্রা হরিণ।

জানা যায়, ১৯৪০-এর দশকে এই দ্বীপটি আস্তে আস্তে জেগে ওঠে। কেওড়া-গেওয়া বনে সমৃদ্ধ সুন্দর একটি দ্বীপ। ১৯৭০ সালে প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর দুর্যোগকবলিত এক জাহাজ থেকে ভেসে আসে দ্বীপে কয়েক বাক্স কমলা। চরে কমলা পড়ে থাকতে দেখে জেলে ও রাখালরা এ দ্বীপের নাম রাখে কমলার চর। তবে নিঝুমদ্বীপের পূর্ব নাম ছিল চর-ওসমান। জানা যায় ওসমান নামের একজন বাথানিয়া তার মহিষের বাথান নিয়ে প্রথম নিঝুম দ্বীপে বসত গড়েন। তখন এই নামেই এর নামকরণ হয়েছিল। পরে হাতিয়ার সংসদ সদস্য আমিরুল ইসলাম কালাম এই নাম বদলে নিঝুমদ্বীপ নামকরণ করেন। সেই থেকে নিঝুমদ্বীপ হিসেবেই এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত কোনো লোকবসতি ছিল না, তাই দ্বীপটি নিঝুমই ছিল। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নিঝুমদ্বীপে জনবসতি শুরু হয়। মূলত হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়ন হতে কিছু জেলে পরিবার প্রথম নিঝুমদ্বীপে আসে। অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ দ্বীপের মাটি চিকচিকে বালুকাময়, তাই জেলেরা নিজ থেকে নামকরণ করে বালুর চর। এই দ্বীপটিতে মাঝে মাঝে বালুর ঢিবি বা টিলার মতো ছিল বিধায় স্থানীয় লোকজন এই দ্বীপকে বাইল্যার ডেইল বা বাল্লারচর বলেও ডাকত। বর্তমানে নিঝুমদ্বীপ নাম হলেও স্থানীয় লোকেরা এখনো এই দ্বীপকে বাইল্যার ডেইল বা বাল্লারচর বলেই সম্বোধন করে।

নিঝুমদ্বীপের বর্তমান আয়তন প্রায় ৯২ বর্গকিলোমিটার। এর উত্তর অংশে রয়েছে বন্দরটিলা। দ্বীপের ৭০ ভাগ মানুষ মৎস্যজীবী ও ৩০ ভাগ কৃষিজীবী। গভীর সমুদ্র ও নদীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছধরে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বসবাসকারীরা থাকে আতঙ্কিত। তবুও জীবিকার টানে তাদের গভীর সমুদ্রে পারি জমাতে হয়।

দ্বীপের চতুর্দিকে বিশাল মৎস্যভাণ্ডার। নানা রকম মাছ ধরা পড়ে জেলেদের জালে। তবে বর্ষার সময় সবচেয়ে বেশি মাছ ধরা পড়ে। বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রলারে করে এসে জেলেরা এই দ্বীপের চার পাশ ঘিরে মাঝ ধরার উৎসবে মেতে ওঠে। নিঝুমদ্বীপ দিনের আলোয় যতটা সুন্দর রাতের নিস্তব্ধতায় ততটাই আকর্ষণীয়। চন্দ্রালোকে জোয়ার-ভাটায় এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এক স্বর্গীয় অনুভূতি সৃষ্টি করে।

জ্যোৎস্নার আলোয় বেলাভূমিতে সাগরের ফেনীল ঊর্মীমালা আছড়ে পড়ার অপূর্ব দৃশ্য কাউকে আলোড়িত না করে পারে না। সাদাটে রুপালি অর্ধেক চাঁদের আলো যে এতটা সুন্দর হতে পারে, তা হয়তো নিঝুমদ্বীপে না গেলে বুঝতেই পারবেন না। দ্বীপের দক্ষিণপ্রান্ত থেকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়।

নিঝুমদ্বীপে খালগুলোর মধ্যে চৌধুরীর খাল, পটকাখালী খাল, সোয়ানখালী খাল, ডুবাই খাল, ধামসাখালী খাল, ভট্রোখালী খাল, কাউনিয়া খাল, লেংটা খাল। খালের জলে হরিণের পানি পানের দৃশ্য এবং পাখিদের স্নান করা ইত্যাদি পর্যটকদের রোমাঞ্চিত করবে। সে দৃশ্য স্বচক্ষে না দেখলে কল্পনা করাও অসম্ভব।

সমুদ্র পাড়ে ১২ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকত, সৈকতে এরা ভ্রমণবিলাসীদের মনে আনন্দ ছড়ায়। পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে নিঝুমদ্বীপের খ্যাতি দিনকে দিন বেড়েই চলছে। যাতায়াত ব্যবস্থাও এখন সহজ হয়ে যাওয়ায় নিঝুমদ্বীপ এখন পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকেই আপনি চাইলে নিঝুমদ্বীপে যেতে পারেন। আর উপভোগ করতে পারেন অপার সৌন্দর্যে ঘেরা নিঝুমদ্বীপকে।

যেভাবে যাবেন

রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক ও নৌ উভয় পথেই হাতিয়া যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সায়েদাবাদ থেকে বাসে সরাসরি নোয়াখালী সদরে, সেখান থেকে সিএনজি অটো রিকশায় হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাট নামক স্থানে পৌঁছা যায়। সেখান থেকে একটি সি-ট্রাক প্রতিদিন সকাল ৮টায় হাতিয়ার নলচিরা ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সদরঘাট থেকে প্রতিদিন সাড়ে ৫টায় হাতিয়ার উদ্দেশে একটি বড় লঞ্চ ছাড়ে। ওই লঞ্চটি পরের দিন হাতিয়া উপজেলার তমরদ্দি ঘাটে গিয়ে থামে। হাতিয়ার যে কোনো ঘাট থেকে বিভিন্ন বাহনে করে সহজেই পৌঁছা যায় নিঝুমদ্বীপে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.