Sylhet Today 24 PRINT

বাঁশবাড়িয়া, সমুদ্রের উপর দিয়ে হেঁটে চলা

সুমন্ত গুপ্ত |  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯

ঘড়ির কাঁটাতে ঠিক তখন দুপুর একটা বাজি বাজি, কিন্তু বৃহস্পতিবার ব্যাংকে কাজের খুব চাপ। এরইমধ্যে মোবাইল ফোন বেজেই চলছে। কাজের যন্ত্রণায় ফোনও ধরছিলাম না। অনেক সময় ধরে বাজছে শুনে ভাবলাম জরুরী কোন ফোন হয়তো। ওপাশ হতে ভেসে এলো সজল মামা’র কণ্ঠ ‘ কিরে ব্যস্ত নাকি’? আমি বললাম কিছুটা ব্যস্ত। মামা বললো নতুন একটি জায়গার সন্ধান পেয়েছি। যেখানে তুই সমুদ্রের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পাড়বি। শুনে আমার কেমন জানি খটকা লাগলো। ধর্মীয় গ্রন্থে শুনেছিলাম বাসুদেব শ্রী কৃষ্ণকে নিয়ে যমুনা নদী পারি দিয়ে ছিলেন। এখনকার সময় তো তা আর সম্ভব হবার কথা নয় তাও আবার সমুদ্র । আমি আবার পাপী মানুষ আমার দ্বারা তো সম্ভব হবারই নয়।

মামাকে বললাম ব্যাপারটা ভেঙ্গে বলতো মামা। মামা বলল এই প্রথম চট্টগ্রামের মানুষ সমুদ্রের উপর দিয়ে হাঁটার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তখন আমার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। আমি আবারো বললাম , মামা ব্যাপারটা খুলে বলো। তখন মামা আমাকে বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতের কথা বলল। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে একটি ছোট্ট বাজারের নাম বাঁশবাড়িয়া বাজার। এই বাজারের মধ্য দিয়ে সরু পিচ ঢালা পথে মাত্র ১৫ মিনিটে পৌঁছানো যায় বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র উপকুলে।

এই সমুদ্র সৈকতের মুল আকর্ষণ হলো, প্রায় আধা কিলোমিটারের বেশি সমুদ্রের ভিতর হেটে যেতে পাড়বি। আমি বললাম ঠিক আছে মামা আমি যাবো। মামার সাথে কথা বলার পর কাজে মন বসাতেই পারছিলাম না। কতক্ষণে অফিস থেকে বের হতে পারবো তার পায়তারা করছিলাম। সপ্তাহের শেষ দিন সাথে মাসের ও কিভাবে যে স্যার কে বলবো একটু আগে বের হতে চাই সেটাই ভাবছিলাম। আমার কাজের তারা দেখে স্যার নিজের থেকেই বললেন “কি সুমন্ত এতো তারাহুরো করছো কোথাও যাবে নাকি?” আমি বললাম স্যার একটা নতুন জায়গার খোঁজ পেয়েছিলাম। বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত, অনেক সুন্দর জায়গা বুঝি। আপনি অনুমতি দিলে একটু আগে বের হতে চেয়েছিলাম। স্যার বললেন, “ঠিক আছে আগে বের হয়ও তবে একটা শর্ত আছে আমার।” শুনে একটু ভয় পেলাম, স্যার আবার কি শর্ত দেবেন। মনে মনে সূর্যদেবের নাম নিতে লাগলাম। স্যার বললেন, “তুমি আসার সময় আমার জন্য রূপচাঁদা মাছের শুঁটকি নিয়ে আসবে।” আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমি বললাম অবশ্যই স্যার আনবো, আপনি না বললেও আমি আনতাম।

বিকেল বেলায় ঢাকার বাসে চেপে বসলাম। ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাত বারোটার দিকে পৌঁছলাম ঢাকা শহরে। সেখানে আমার অস্থায়ী ডেরা মাসির বাসায় অবস্থান নিলাম। সূর্যদেব দৃষ্টি মেলে তাকানোর আগেই সজল মামা’র ফোন। এই ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হয়ে নে। আমারা একটু পরেই বের হবো। গত রাতের যাত্রা পথের ক্লান্তি ঘেরে ধরেছে আমায়। এরপরেও নতুন গন্তব্যে যাবো এর নেশায় লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে গেলাম। দ্রুত প্রস্তুতি পর্ব শেষ করে মামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে মামা চার চাকার বাহন নিয়ে উপস্থিত সাথে মামা’র বন্ধুরদল। সূর্যদেবের আভা তখনো ছড়ায় নি। মিষ্টি এক সকালে আমরা এগিয়ে চলছি। মহাসড়কে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলছে আমাদের চার চাকার বাহন। সকাল বেলা তাই রাস্তায় তেমন একটা যানজট এর মুখোমুখি হতে হলো না আমাদের।

এগিয়ে চলছি প্রায় দুই ঘণ্টা হয় সবাই কে নিদ্রা দেবী আবিষ্ট করেছে শুধু মাত্র পাইলট মহোদয় ছাড়া। সময়ের সাথে সাথে আমরা উপস্থিত হলাম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা পদুয়ার বাজার অবস্থিত নুরজাহান হোটেলে। গাড়ি থেকে নেমেই স্বল্প সময়ের মধ্যে পেট পূজা শেষ করে আমরা গাড়িতে চেপে বসলাম। আমরা এগিয়ে চলছি মহাসড়ক পেড়িয়ে। দেখতে দেখতে আমরা সীতাকুণ্ডে এসে পৌঁছলাম। দূর থেকে কানে ভেসে আসছিল সমুদ্র দেবের গর্জন। তখন বুঝলাম যে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। সীতাকুণ্ড থেকে কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

ঘড়ির কাঁটাতে তখন ঠিক দুপুর একটা। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার মত সময় লেগে গেছে আমাদের। বাঁশবাড়িয়া যাওয়ার পথটা অসাধারণ। গাছের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যদেব খেলা করেন ওখানে। উপরে খোলা আকাশ পাশে খোলা জায়গা, একটু সামনে এগিয়ে গেলে বিশাল সমুদ্র। ঝাউ বাগানের সারি সারি ঝাউ গাছ ও নতুন জেগে উঠা বিশাল বালির মাঠ, সব মিলিয়ে এ এক অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে। আজ আকাশের মন ভালো তাই মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আমরা এক পাশে জুতো রেখে দৌড় দিলাম সমুদ্রের দিকে। নিজেদের ভিজিয়ে নিলাম সমুদ্রের জলে। এই আনন্দ মনে হয় লিখে প্রকাশ করার মতো না। হাতের ডান দিক দিয়ে একটু সামনে এগিয়ে যাবার পর দেখা পেলাম বাঁশের তৈরি ব্রিজের। মামা বললেন, “এই নে তোর সমুদ্রের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবার পথ।”

ব্রিজের উপর দিয়ে হেঁটে একদম শেষ প্রান্তে পৌঁছলাম। একটু পর পর ঢেউ আছড়ে এসে আমার পায়ে পড়ছে। নিজেকে মনে হচ্ছে সমুদ্রের বুকের উপর আমি দাঁড়িয়ে আছি। দেখা হলো ঐ এলাকার মুরুব্বী ফারুক মিয়ার সাথে তিনি বললেন, “এ ব্রিজটা কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাধীন, এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির মালিকানায় নির্মিত যা একান্তই সন্দ্বীপবাসীদের চলাচলের জন্য। ব্রিজটা প্লাস্টিকের, কারণ সমুদ্রের উপর করা, আর লবণাক্ত পানি লোহা বা স্টিল তাড়াতাড়ি ক্ষয় করে ফেলে তাই প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি।আপনারা চাইলে স্পিড বোটে করে জনপ্রতি ৪০০টাকা (আপডাউন) সন্দ্বীপ ঘুরে আসতে পারেন। ২০মিনিট মত সময় লাগে।”

মামা কে বললাম কিন্তু কেউ আর সায় দিলো না। কারণ সূর্যদেবে পাটে যাওয়ার সময় ও ঘনিয়ে আসছিল। পাশে দেখা পেলাম ম্যানগ্রোভ বন এর মত শ্বাসমূল এর। আমরা পাশে ঝাউ বনে ঘুরতে গেলাম। কিছুটা পথ আবার কর্দময়। এর পরেও সমুদ্রের পারে হেঁটে বেড়ানোর মজাই আলাদা। দেখতে দেখতে সূর্যদেবের বিদায় নেবার পালা চলে এলো সাথে আমাদের ও। তবে বলে রাখা ভালো বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত অবস্থিত ব্রিজটি মজবুত খুঁটি ছাড়া নির্মিত, যার কারণে সাবধানতা বজায় করা উচিত। অহেতুক বড় দল নিয়ে ব্রিজে না ওঠাই ভালো। যেহেতু কোন বেষ্টনী নেই সেহেতু জোয়ার ভাটার সময় মেনে চলা উচিত।

যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে সীতাকুণ্ডে অথবা চট্টগ্রাম  এর অলংকার থেকে সীতাকুণ্ড যাওয়ার যেকোনো বাস বা টেম্পুতে করে বাঁশবাড়িয়া নামতে হবে। ভাড়া ৩০-৪০ টাকা। অলংকার থেকে চট্টগ্রাম হাইওয়ে ধরে ২৩ কিলোমিটার যেতে হবে। এটা বাড়বকুন্ডের একটু আগে। বাঁশবাড়িয়া নামার পর সিএনজি তে করে আরও আড়াই কিলোমিটার গেলে বেড়িবাঁধ পাওয়া যাবে। সিএনজি ভাড়া জনপ্রতি ২০টাকা করে। চাইলে রিজার্ভও নেওয়া যায়। ওখানেই বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.