Sylhet Today 24 PRINT

১৩ মাস থেকে কোমায় তরুণী, নিঃস্ব পরিবার

একুশ তাপাদার |  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ইনসেটে চামেলীর সুস্থ অবস্থার ছবি

২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর,  নোয়াখালী সরকারি কলেজের গনিতে স্নাতক প্রথম বর্ষে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ রিহাম আফসানা চামেলী দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হয়ে বাড়ি ফিরছিল। এসএসসি ও এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পাওয়া নোয়াখালীর কৃষক মিজানুর রহমানের এই মেয়ের গণিতের প্রতি ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। কিন্তু ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাড়ি ফেরার পথেই ফেরা না ফেরার এক অদ্ভুত, অসহনীয় দোলাচলে জীবন মৃত্যুর মাঝখানে পড়ে আছে সে।

ওইদিন সিএনজি অটোরিকশায় চেপে নির্ভার মনে বাড়ি ফিরছিল চামেলি ও তার চাচাত বোন। হঠাৎ  দ্রুতগামী বাসের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে বোনের মৃত্যু হলেও মাথায় মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় কুড়ি বছরের এই তরুণী ।  চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসার পর অবস্থা গুরুতর হওয়ায়  ইন্টনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) পাঠানো হয় তাকে। ২০১৫ পেরিয়ে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসও পার হয়ে যাচ্ছে,  আজও একইভাবে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছে চামেলী। দীর্ঘ ১ বছর ১ মাস অসাড় হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে 'পৃথিবীতে আছে' এই তরুনী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় কোন রোগী আইসিইউতে থাকেনি। আইসিইউতে প্রতিনিয়ত  গুরুতর রোগীদের স্থান সংকুলানের সমস্যা থাকায় ৮ মাস পর পোস্ট অপারেটিভ কক্ষের এক কোনায় প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিয়ে রাখা হচ্ছে তাকে।  

চামেলী কোমা থেকে ফিরবে সেই প্রতীক্ষায় এক বছর থেকে জগত সংসার সব পেছনে ফেলে হাসপাতালে পড়ে আছেন মিজানুর রহমান  ও জিন্নাতুননেসা দম্পতি। মিজানুর রহমান জানান এই দীর্ঘ সময়ে নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের চরকাকড়া গ্রামের বাড়িতে একবারই যেতে পেরেছিলেন। হাসপাতালই এখন তাদের ঘর সংসার। এদিকে চামেলীর চিকিৎসা করাতে প্রায় নিঃস্ব হতে চলেছেন তারা। ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গেছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। হাসপাতালে আইসিইউ'র বেড ভাড়া না লাগলেও নাক দিয়ে খাওয়ানোর জন্য দামি দুধ, তরল খাবার, ঔষধ যোগান দিতে হয় তাদেরই। আছে আনুসাঙ্গিক আরও অনেক খরচ।

এভাবে আসলে আর কতদিন? এমন প্রশ্নের জবাবে অসহায়ভাবে মিজানুর বলেন, "রূহটা (প্রাণ) তো আছে, হাত-পাও নড়ে...ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়, চোখ দিয়ে পানি পড়ে, নাক দিয়ে খায়। মেয়েটা তো মরেও যায়নি আবার বেঁচেও নেই, কি করব বাবা।"

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে পরিছন্নতাকর্মী সবার কাছে 'মিজান কাকা' বলে পরিচিত হয়ে উঠা চামেলির বাবা বলেন, "হাসপাতালের সবাই আমার নজর রাখেন, আমি ও আমার স্ত্রীর জন্য অতিরিক্ত খাবার দেয়া হয়। বড় বড় ডাক্তাররা খোঁজ খবর রাখেন। কিন্তু মেয়ের শারীরিক অবস্থার উন্নতির আশ্বাস কেউ দিতে পারেন না।"

আইসিইউতে প্রতিদিন পুরোনো রোগী মারা যায়, নতুন রোগী আসে। মিজানুর-জিন্নাতুননেসা সংকটময় মানুষের আসা যাওয়ার মিছিল দেখেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের আইসিইউর ওয়েটিং রুমে বসে। এই ওয়েটিং রুমই এখন তাদের ঘর-সংসার। বলা যায় প্রতীক্ষালয়। ব্যাগ থেকে তারা বের করে দেখান  মেয়ের সুস্থ অবস্থার ছবি। প্রাণোচ্ছল তরুনীর ওই ছবি দেখে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা চামেলিকে মেলানো যায় না। প্রায় কঙ্কালসার দেহ, নাক দিয়ে খাবার দেয়ার জন্য নল। মুখ বসানো সাকশন যন্ত্র। নিথর দেহে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এনোস্থোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা: গুলশান আরা চৌধুরী সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে সংজ্ঞাহীন অবস্থা প্রায় ১৩ মাস ধরে মেয়েটি এখানে আছে, ওর এমনিতে কোন রেসপন্স নেই, মাঝেমাঝে নিজ থেকে হাত-পা নাড়ায় কিন্তু আমরা কোন সিগন্যাল দিলে সেটা সে রিসিভ করতে পারে না।"

"এই অবস্থা থেকে মিরাকল না ঘটলে কিছুই বলা যাচ্ছে না বলে।" যোগ করেন গুলশান আরা।

তিনি বলেন, "খাতা কলমে চামেলী জীবিত কিন্তু অসাড় অর্থাৎ জীবিত থাকলেও জীবনের কোন বোধ তাকে স্পর্শ করছে না। মাঝেমাঝে খবরে দেখা যায় ২০ বছর পর হঠাৎ কেউ কোমা থেকে ফিরে এসেছে ওর বেলায়ও এমনটি হতে পারে আবার নাও হতে পারে।"

গুলশান আরা বলেন, "পরিস্থিতি আসলে জটিল, চিকিৎসা বিজ্ঞানে কিছু সাপোর্ট দেয়া ছাড়া কোন অপশন আর নেই"।

ডাক্তাররা কিছু সাপোর্ট দিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার  সায় দিলেও গ্রামেগঞ্জে মেয়ের জন্য প্রয়োজনীয় মেডিকেল ফুড আর ঔষুধ যোগাড় করতে পারবেন না। হাসপাতালে অনেকের সাহায্য পাওয়া যায়, বাড়িতে গেলে তাও মিলবে না বলে সেকারণে বাড়ি যাওয়ার সাহস করতে পারছেন না মিজানুর।

এই অবস্থা থেকে চামেলী ফিরে আসবে কিনা কিংবা কতদিন এভাবে বেঁচে থাকবে বলার কোন উপায় নেই। যন্ত্রনাবিদ্ধ কোন মানুষকে 'মুক্তি' দিতে বাইরে থেকে মৃত্যু ঘটনারও কোন বিধান নেই। দীর্ঘদিন কোমায় থেকে ফিরে আসা এবং না আসা নিয়ে আন্তর্জাতিক মাধ্যমে সাম্প্রতিক অতীতে দুটি খবর পাওয়া যায়। ২০১৫ সালের  ২২ সেপ্টেম্বর খবর বের হয়  জিজাস আপারিচো নামের স্পেনের এক যুবক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দীর্ঘ ১১ বছর কোমায় থাকার পর চেতনা ফিরে পেয়েছেন। আরেকটি খবর ছিল মর্মান্তিক। অরুণা শানবাগ নামের এক ভারতীয় নারী ৪২ বছর কোমায় থাকার পর ২০১৫ সালের ২৭ মে মৃত্যুবরণ করেন। পেশায় নার্স এই নারী ১৯৭৩ সালে পরিছন্নতাকর্মী দ্বারা ধর্ষিত ও শারীরিকভাবে গুরুতর আহত হন। ২০১৫ সালে যখন তিনি 'আনুষ্ঠানিকভাবে' মৃত্যুবরণ করেন তখন তার শারীরিক বয়স দাঁড়ায় ৬৬ বছর। ২০১০ সালে অরুনার  স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানিয়েছিলেন তাঁর এক বন্ধু। আদালতে তা খারিজ হয়ে যায়।

চামেলীর বাবা-মা তাদের জমানো সব টাকাই এরমধ্যে খরচ করে ফেলেছেন। অমানবিক এক অপেক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা। এই অমানবিক অপেক্ষার ধকল সইবার আর্থিক সামর্থ্য নেই পরিবারটির। কয়েকমাস আগে চট্টগ্রামের স্থানীয় পত্রিকায় তাদের অসহায়ত্বের গল্প প্রকাশের পর কিছু সাহায্য এসেছে, মেডিকেলের ডাক্তাররা যতটুকু সম্ভব দেখভাল করছেন কিন্তু এতেও আর  কুলিয়ে উঠা সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থা থেকে পরিত্রানের জন্য দরকার আরও অর্থের। কিংবা চামেলির 'এক্সিস্টেন্সের' খরচ যদি রাষ্ট্র বহন করে তাহলেও বেঁচে যায় পরিবারটি।

মিজানুর রহমান বলেন, "আমি মানুষের সাহায্য চাই, আমার বিশ্বাস এখনো অনেক মানুষ আছে যারা অল্প হলেও আমাকে সাহায্য করবে"।

তাদের সাহায্য করতে  এই নাম্বারে ( ০১৮৩৩৫৭৭২৫৪)  বিকাশের মাধ্যমে সাহায্য পাঠানোর আহবান করেছেন মিজানুর রহমান।




টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.