Sylhet Today 24 PRINT

বড়লেখায় যেমন ছিল ভোটের চিত্র

তপন কুমার দাস, বড়লেখা |  ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮

অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এবং বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে ভোট গ্রহণ হয়েছে মৌলভীবাজার-১ আসনের বড়লেখায়। এদিন বেশিরভাগ কেন্দ্রেই ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। আবার কোথাও ছিল কম। তবে পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারী ভোটারের উপস্থিতি ছিল বেশি। বেশিরভাগ কেন্দ্রের সার্বিক পরিস্থিতি ছিল শান্তিপূর্ণ। কয়েকটি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে ঘটেছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা। দুইটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ ছিল অন্তত দুই ঘণ্টা।

অন্যদিকে বড়লেখায় ভোটের দিন অন্তত ১৫টি কেন্দ্র থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজেদের এজেন্ট বের করে দিয়ে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ করে বিএনপি। বিএনপির নেতাকর্মীরা এই নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সরেজমিনে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে এমন অভিযোগ পাওয়া যায়।

গল্লাসাঙ্গন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : সকাল ৯টা। এই কেন্দ্র ঘুরে বের হবার সময় হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে সড়কের উপর। স্বজনের সহায়তায় হুইল চেয়ারে করে ভোট দিতে আসছেন এক বয়োবৃদ্ধ নারী। অসুস্থ শরীর নিয়ে ভোট দিতে আসার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে এ নারী জানান, কষ্ট যতই হোক বাবা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারলে আমি খুশি। এ কেন্দ্রের কয়েকজন ভোটারদের সাথে কথা বললে তাঁরা শান্তিপূর্ণ ভোট হবার কথা জানিয়েছেন।

পাবিজুরীপার, সায়পুর, নান্দুয়া ও সুজাউল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র : সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত এই চার কেন্দ্র ঘুরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে বললে উভয়পক্ষই ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।

পাবিজুরি পার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুস শহিদ খানের সাথে কথা হয়। তিনি এ কেন্দ্রের ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে এর কিছুক্ষণ পরই মুঠোফোনে তিনি জানান, পৌর শহরের সিংহগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে তাদের এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়েছে।

নান্দুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : এ কেন্দ্রে সোয়া ১১টার দিকে ভোট দিতে আসেন একজন নারী চা শ্রমিক রমনি দাস। ভোট কেন্দ্র থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরের পাল্লাথল চা বাগানের বাসিন্দা তিনি। জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী। কিন্তু নৌকার প্রতি তাঁর ভালোবাসা দমাতে পারেনি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। স্বামী ও স্বজনের কাঁধে চড়ে আসেন ভোট দিতে। ভোট দিয়ে ফেরার পথে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। রাখঢাক না রেখেই তিনি বলেন, 'নাউকায় (নৌকায়) ভোট দিয়েছি। আমার শেখ হাসিনা আর নাউকা (নৌকা) পাশ করলে খুশি থাকমু।’

ষাটমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : বেলা ১২টার দিকে এই কেন্দ্রে হামলার ঘটনা ঘটে। বিএনপি নেতাকর্মীরা কেন্দ্রের বাইরে থেকে ভেতরে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে অতর্কিত হামলা চালায়, এমন অভিযোগ আওয়ামী লীগের। হামলায় এই কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক আহত হন। এ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট জেহিন সিদ্দিকী বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চলছিল। তবে বিএনপির নেতাকর্মীরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে ভোটের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করে।’

এই কেন্দ্রের ঘটনায় বিএনপির পক্ষ থেকে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে জানানো হয়,  ভেতরে জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিবাদ করায় এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়।

পিসি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় : দুপুর সোয়া ১২টায় এ কেন্দ্রে এজেন্ট বের করে দিয়ে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ করেন উপজেলা বিএনপির নারী নেত্রী ও ভাইস চেয়ারম্যান রাহেনা বেগম হাসনা। তিনি বলেন, ‘এটাকে নির্বাচন বলা হয় না। মৃত ও প্রবাসে থাকা ব্যক্তির ভোট দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনে অভিযোগ দিয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এছাড়া কেছরিগুলসহ বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে আমাদের এজেন্ট বের করা হয়েছে।’

এই কেন্দ্রে কথা হয় সম্মিলিত জাতীয় জোটের প্রার্থী আহমদ রিয়াজের সাথে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, ‘জনগণ উৎসব করে ভোট দিচ্ছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে পাচ্ছি। প্রশাসন নিরপেক্ষ রয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে কমিটমেন্ট দিয়েছিলেন। একটা সুষ্ঠু নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ আমি দেখতে পাচ্ছি। সুষ্ঠু সুন্দর নিরপেক্ষ নির্বাচন হচ্ছে।’

বড়খলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : এ কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ করা হয়। এই কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট হিফজুর রহমান মুঠোফোনে কল করে এই অভিযোগ করেন।

অজমির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : এ কেন্দ্রে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। এই কেন্দ্রে এজেন্ট বের করে দিয়ে জোর করে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ করেন যুবদল নেতা পৌর কাউন্সিলর আব্দুল হাফিজ ললন ও জাহিদুল ইসলাম মতিন। দুজনই জানিয়েছেন, এ কেন্দ্রে ১৩-১৫ বছরের ছেলেরা ভোট দিয়েছে। জোর করে এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়। মরা (মৃত) ও বিদেশিদের ভোট দেওয়া হয়।

বর্ণী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : বর্ণী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের এজেন্ট আব্দুন নূর বলেন, সকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ চলছিল। কিন্তু হঠাৎ দুইটার দিকে বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কেন্দ্রে হামলা করে। এতে বর্ণী ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সহসভাপতি হাসিম আহমদ আহত হন। এই ঘটনার পর কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ভোট গ্রহণ বন্ধ রাখেন। পরবর্তীতে এ কেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করা হলে পুনরায় ভোট গ্রহণ কার্যক্রম চালু হয়।
এ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম সংঘর্ষ ও ভোট বন্ধ ও পুনরায় চালুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

সৎপুর বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : এই কেন্দ্রে সকাল থেকেই এজেন্ট বের করে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ করে বিএনপি। উপজেলা জিয়া পরিষদ নেতা লুৎফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। সকাল থেকে কয়েক দফা এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়। ভয়ভীতি দেখানো হয়।’

পাকশাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : পাকশাইল কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ বিএনপির ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মাঝে ভোট গ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ রাখেন কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম। দুপুর ১টা থেকে আনুমানিক ৩টা ১০ মিনিট পর্যন্ত এই কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ কার্যক্রম স্থগিত ছিল। পরবর্তীতে এই কেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করার পরপরই ভোট নেওয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে আর কোনো বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া যায়নি।

বর্ণী ইউনিয়নের বিএনপির আহবায়ক লোকমান উদ্দিন বায়েছের অভিযোগ, ‘বর্ণীর দুই কেন্দ্রে আমাদের এজেন্টদের বের করে দিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীরা নৌকায় সিল মেরেছে। ভোট গ্রহণ মন্থর করা হয়। মহিলারা ঠিক মতো ভোট দিতে পারেননি।’

তবে একই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মুহিতের দাবি হামলা চালিয়েছে বিএনপিই, ‘বিএনপির এসব কথা একেবারে বানোয়াট ও মিথ্যা। তারাই ওই দুই কেন্দ্রে আমাদের নেতাকর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছে। আমাদের কয়েকজন আহতও হয়েছেন।’

মাইজগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় : এই কেন্দ্রে ১১টার থেকে বিএনপির এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ করা হয়েছে। পরবর্তীতে বিএনপির এজেন্টরা ভোট কক্ষ থেকে বের হয়ে যান।

এদিকে যে সকল কেন্দ্র নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেকল কেন্দ্রের দায়িত্বরত প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করলে তাঁরা বিএনপির এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘তাঁরা এজেন্ট না দিয়ে ভুল তথ্য প্রচার করেছেন।

ভোটের গণনা শেষে বিছরাবাজার কেন্দ্রে বিএনপি নেতার ওপর হামলা:

ভোটের গণনা শেষে বড়লেখা পৌর বিএনপির অর্থ বিষয়ক সম্পাদক মো. শফিকুজ্জামান শফিকের ওপর হামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা তার ওপর এই হামলা চালায় বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে। পরে তাকে উদ্ধার করে পাশ্ববর্তী বিয়ানীবাজার উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে সিলেটে প্রেরণ করা হয়।


আহত মো. শফিকুজ্জামান শফিক

ফলাফল

স্থানীয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি ফলাফলে আওয়ামী লীগ প্রাথী মো. শাহাব উদ্দিন নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৭৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি বিএনপি প্রাথী নাসির উদ্দিন মিঠু ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ৬৫ হাজার ৮১৪ ভোট।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.