Sylhet Today 24 PRINT

ইতিহাসের নির্মোহ সাধক জাফর ওয়াজেদ

মাসকাওয়াথ আহসান |  ০৯ জুন, ২০২০

জাফর ওয়াজেদ

বাংলাদেশে যেহেতু কাজের কাজ ফেলে ইতিহাস বিকৃতির একটি ধারা রয়ে গেছে; তাই ইতিহাস বিকৃতির ভ্রান্তি নিরসনে নিয়মিত আমরা সাহায্য পেয়েছি মহিউদ্দিন আহমদ, আফসান চৌধুরী, জাফর ওয়াজেদের মতো ইতিহাস-চর্চাকারীদের কাছ থেকে। এই তিনজন মানুষের ইতিহাস চর্চার মধ্যে প্যাশন আছে; পরের প্রজন্মকে সত্য তথ্য খুঁজে নিতে সাহায্য করার আকাঙ্ক্ষা আছে। এই ইতিহাসবেত্তাদের প্রস্তুতি দীর্ঘ। এরা তিনজনই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত তরুণ ছিলেন। ১৯৭১-এর স্বপ্নের এই প্রজন্মের চর্চার জায়গা রাজনীতি-শিল্প-সাহিত্য। যা কিছু সুন্দর তা। ফলে তাদের সাংস্কৃতিক বোধ; ইতিহাসকে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে সাহায্য করেছে।

এদের মধ্যে মহিউদ্দিন আহমদ আর আফসান চৌধুরীর প্রকাশনা রয়েছে। আর জাফর ওয়াজেদের ইতিহাস অনুসন্ধানের ধরণটি জাদুঘরের কিউরেটরের মতো। প্রামাণিক দলিল-ছবি-পেপার কাটিং-বইয়ের পৃষ্ঠার স্ক্রিনশট কী নেই তাতে।

বিজ্ঞাপন

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এসে যাওয়ার পর ডাকসুর সাবেক সাহিত্য সম্পাদক, সাংবাদিক, কলামনিস্ট জাফর ওয়াজেদকে আমরা কাছ থেকে পেতে শুরু করলাম। শুধু মুক্তিযুদ্ধ বিষয় নয়; যে কোন বিষয়ে তথ্য যাচাইয়ে উনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। আমাদের সংবাদপত্রের স্বর্ণযুগে প্রত্যেক হাউজে এমন কিছু মানুষ ছিলেন; যারা নিউজরুমে হাঁটতে হাঁটতে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতেন। জাফর ওয়াজেদও ব্যস্ত সাংবাদিক-লেখক; কিন্তু ইনবক্সে কোন তথ্য জানতে চাইলে; উনি উত্তর দেননি এমনটা ঘটেনি। এটা স্বর্ণযুগের প্রজ্ঞাবান সাংবাদিকেরাও করতেন। কেউ কোন তথ্য জানতে চাইলে; সময় বের করে নিয়ে জানাতেন তারা। জ্ঞানের জগত এ কারণেই শিষ্টাচারের জগত বলে আদৃত।

মহিউদ্দিন আহমদ, আফসান চৌধুরী, জাফর ওয়াজেদ; আমার দেখা তিনজন ইতিহাসবেত্তা; যারা জীবনের আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন ইতিহাস অনুসন্ধানে। ফলে গোটা ঢাকা যখন স্বর্ণযুগের সাফল্যের সংজ্ঞা পালটে দিয়ে ধূসর যুগের মোহরের দিকে ছুটেছে; এই তিনজনকে আমরা দেখতে পাই; সাদাসিধে জীবনের মৌনব্রতে।

সাধনা ছাড়া প্রজ্ঞার জগতে ব্যুৎপত্তি অর্জন অসম্ভব। তাই সাফল্যের কোন শর্টকাট খোঁজেননি তারা। যে কারণে তিনজনই সফল মানুষ; যে যার ভুবনে।

ইন্টারনেট যুগ আসার পর; রবীন্দ্রনাথ স্কুল পালিয়েছিলেন কিংবা বিল গেটস ড্রপ আউট হয়েছিলেন; এই সাহসে কিছু স্কুল পালানো কিংবা ড্রপ আউট ছাত্র ইতিহাস চর্চায় ব্রতী হন। এটা উৎসাহব্যঞ্জক; কিন্তু শিক্ষার ভিত্তি ভালো না হলে যেটা হয়; "আমি আমি আমি"-র কামড়ে রাজজ্যোতিষী কিংবা জিডিপি রাজার দেশের বিদূষক হয়ে পড়ে নব্য ইতিহাসবিদেরা। শুধু তাই নয়, ফেসবুকে দেশপ্রেম ও চেতনার চেকপোস্ট বসিয়ে ফেলে; নিজেকে অথোরিটির জায়গায় বসিয়ে, দেশের কৃতি মানুষদের আইকন ভেঙে ভেঙে লিলিপুটিয়ানদের চিন্তা উচ্চতার সমাজ সৃজনের ইচ্ছা জাগে। গায়ক মাহফুজুর রহমানের যেমন গান গেয়ে ঈদের দ্বিতীয় দিনে দুনিয়া কাঁপিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।

এই কারণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাটা প্রয়োজন হয়; প্রয়োজন হয় দীর্ঘ প্রস্তুতি প্রজ্ঞার যে কোন শাখায় কাজ করতে। রবীন্দ্রনাথ বা বিল গেটস ব্যতিক্রম। তাদের স্কুল পালানো আর ইউনিভার্সিটি ড্রপ-আউটের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অনেক কিশোর বা তরুণই নিজেদের সর্বনাশ করে।

সম্প্রতি ফেসবুকের একটি পোস্টে ইতিহাসবেত্তা জাফর ওয়াজেদের দেয়া একটি তথ্য ভুল হওয়ায়; নব্য ড্রপ আউট ইতিহাসবেত্তারা তার আইকনটি ভেঙে নিজেদের ইতিহাসের বাদামের ডালা নিয়ে ফেসবুকে ঘুরতে চেষ্টা করছে।

এটি সমাজের একটি হীন প্রচেষ্টা। জাফর ওয়াজেদের মতো আলোর মানুষেরা এ সমাজে নিয়ত প্রতিকূলতার মধ্যেও অধ্যয়নের সাধনায় টিকে থেকেছেন। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জামায়াত-শিবিরের নৃশংস জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়ে প্রতিবেদন করে; নিজের জীবনকে ঝুঁকির মাঝে ফেলেছিলেন জাফর ওয়াজেদ। তিনি সবসময়ই নিরাপোষ। এই আওয়ামী লীগ আমলেও একটি সাংবাদিক সংগঠনের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ; আর কেউ না করলে তিনিই করেছেন। আমাদের সমাজে যে ঠগি-কোলাবরেটর প্রকৃতির লোকেরা সবসময় সরকারে মিশে যেতে পারে; সেরকম কিছু নব্য আওয়ামী লীগের বাদামওয়ালারা কুষ্টিয়ার আদালতে জাফর ওয়াজেদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলো।

যোগ্য এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক পিআইবি'র মহাপরিচালক নিযুক্ত হওয়ার পর; সেখানে সাংবাদিক প্রশিক্ষণে দ্রুতি আসে; প্রকাশনা ঋদ্ধ হয় তথ্য মন্ত্রণালয়ের এ প্রতিষ্ঠানে। যে জাফর ওয়াজেদ তরুণ বয়সে ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে সাংগঠনিক দক্ষতার অনুশীলন করেছেন; তিনি যে পিআইবি সংগঠনের কাজে সফল হবেন; এতো বলাই বাহুল্য।

মহাপরিচালক নিযুক্তির পরেও জাফর ওয়াজেদ সেই একই রকম সাদাসিধে সত্যানুসন্ধানী মানুষটি রয়ে গেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে যে, সত্য উচ্চারণ এখানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে ফেসবুকে জাফর ওয়াজেদের দেয়া তথ্য জামায়াত-শিবিরের লোকদের ক্ষুব্ধ করে; কিছুটা ক্ষুব্ধ বিএনপিও হয়।

এখন ফেসবুকের একটি পোস্টে একটি তথ্য ভুল হওয়ায়; নব্য আওয়ামী লীগের ইতিহাসের বাদামওয়ালাদের দেখছি; মুঠো পাকিয়ে ঘুরছে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক ডাক্তার; যিনি গণস্বাস্থ্যের কিট আটকে দেবার কীটদের পক্ষে ভুল বানানে অনেক স্ট্যাটাস লিখেছেন; তিনি গায়ে জাতীয় পতাকা জড়িয়ে "জাফরুল্লাহ"-র গণস্বাস্থ্যের আইকন ভেঙে নিজেই জাতির ডাক্তার হিসেবে ভুঁই ফুঁড়ে উঠতে; সাত সমুদ্র তেরো নদী সাঁতরে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন; স্বাস্থ্য-ব্যবসার জান্নাতুল ফেরদৌস কায়েম করতে।

এই ভুল বানানে গণস্বাস্থ্যের টেস্টিং কিটের যা-তা সমালোচনা করে হয়ে উঠতে চাওয়া নতুন জান্নাতুল ফেরদৌস স্বাস্থ্য সম্পর্কে; জাফর ওয়াজেদ একটি ভুল তথ্য দিয়েছেন।

নতুন জাতির ডাক্তার দাবি করেছেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের তিনি আত্মীয় নন। কিন্তু গণস্বাস্থ্যের কিটের যে ভুল বানানে অশালীন সমালোচনা উনি করেছেন; তা ভার্চুয়ালি ডা জাফরুল্লাকে হত্যার অনুরূপ দৃশ্য। কাজে জিঘাংসা যে তার মধ্যে আছে; এই তথ্যটির প্রামাণিক স্ক্রিনশট আছে।

একাত্তরের স্বপ্নের সত-সাধক প্রজন্মকে তাদের প্রাপ্য সম্মানের কিছুই আমরা কিছুই দিতে পারিনি; তাই বলে তাদের অসম্মান করে হাঞ্চব্যাক অফ চেতনাদামের যে চোট-পাট দেখছি; এ ভীষণ আপত্তিজনক।

ভুল তথ্য প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াতেও প্রচার হয়; ভুল স্বীকার করে নিলে; আবার দর্শক ঐ মিডিয়ায় আস্থা রাখতে পারে। কাজেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবার মতো কোন তথ্য জাফর ওয়াজেদ দেননি।

আর মুশতাক তো মীরজাফরের আত্মীয় নন; তবু বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছেন। ফলে মুশতাকের আত্মীয় না হয়েও কেউ যদি ফেসবুকে ভুল বানানে মুক্তিযোদ্ধা ডা জাফরুল্লাহর সুকৃতি খুন করে থাকে; সে-ও তো খুনেরই ভার্চুয়াল রূপ।

মাসকাওয়াথ আহসান: লেখক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.