রাজেশ পাল | ১১ জুলাই, ২০২০
শিশুটির জন্ম হয়েছিল আহমদিয়া বা কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের এক মায়ের গর্ভে। কিন্তু জন্মের কিছু সময় পরই সে মারা যায়। তখন তার লাশ দাফন করা হয় নির্দিষ্ট কবরস্থানে, যেখানে বিগত ৫০ বছর যাবত নিজেদের সম্প্রদায়ের মৃতদেহগুলো দাফন করে আসছিলেন তাঁরা। কিন্তু আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ঘরে জন্ম নেয়ায় সেই লাশ কবর থেকে ছুড়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে স্থানীয় 'তৌহিদী জনতা'! ঘটনাটি ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে।
মানুষের নাকি জন্মের আগে আর মৃত্যুর পরে কোনো শত্রু থাকেনা। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত শত্রু সৈন্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে মর্যাদা সহকারে কবর দেয়ার নির্দেশনা দেয়া আছে সেই কারণেই। কিন্তু এই দুর্ভাগা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে হিন্দুর চিতা জ্বলে, বৌদ্ধ আর খ্রিস্টান পান সমাধির অধিকার। পান আদিবাসীরাও। শুধু একটি সম্প্রদায়ের মানুষ এতোটাই দুর্ভাগা যে আমাদের মোল্লাতন্ত্র হুকুমজারি করে মৃত্যুর পরে তাদের সদ্যোজাত শিশুর লাশ পর্যন্ত কবর থেকে তুলে ছুড়ে ফেলে দিতে!
পাকিস্তান আমলে জামায়াতে ইসলামীর আধ্যাত্মিক গুরু মওদুদির উস্কানিতে কয়েক হাজার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়। যে হত্যাকাণ্ডের কারণে খোদ পাকিস্তানের আদালতে ফাঁসির রায় হয় মওদুদির। যদিও পাক সামরিক জান্তার দয়ায় শেষ মুহূর্তে মৃত্যুদণ্ড রহিত করা হয় তার। যেটা নিজের পিতার সমালোচনা করে লেখা বইতে আফসোসের সাথেই লিখেছিলেন মওদুদির জামায়াতবিরোধী পুত্র।
আর আজ ৬০ বছরের কাছাকাছি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে ইসলামিক স্টেট অব পাকিস্তান নয় বরং পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশে আবারও দেখতে হলো এই সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে উগ্রপন্থী ধর্মান্ধদের নির্মমতার চরমতম আরেকটি উদাহরণ। কয়েকদিন আগে যখন মোল্লাদের ফতোয়া শুনে পাকিস্তানে হিন্দুদের কৃষ্ণ মন্দির নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন ইমরান খান , সেদিন আমি বিন্দুমাত্র অবাক হইনি, দুঃখও লাগেনি। কারণ ধর্মের নামে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানে এটা একেবারেই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত ঘটনা। কিন্তু আজ আমি বাকরুদ্ধ, শোকার্ত এবং ক্ষুব্ধ চরমভাবেই। কারণ পাকিস্তানের জন্মের মূল ভিত্তি জিন্নার "One country two nation theory"-কে এক যমুনা রক্তে ভাসিয়ে দিয়ে একদিন ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকেই ফিনিক্স পাখির মতোই জেগে ওঠা আমাদের বাংলাদেশ নামের অন্তত কাগজে কলমে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটিতে দেখতে হলো এই মর্মস্পর্শী ঘটনাটি।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা থেকেই বলি,
তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীদের
তুমি ঘৃণা নাহি করে,
আপনি তাদের করিয়াছ সেবা
ঠাই দিয়ে নিজ ঘরে।
ভিন ধর্মীর পূজা মন্দির
ভাঙিতে আদেশ দাওনি, হে বীর!
আমরা আজিকে সহ্য করিতে
পারিনাতো পর মত।
ক্ষমা করো হযরত।তুমি চাও নাই ধর্মের নামে
গ্লানিকর হানাহানি,
তলোয়ার তুমি দাও নাই হাতে
দিয়াছ অমর বাণী।
মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা
সার করিয়াছি ধর্মান্ধতা,
বেহেস্ত থেকে ঝরে নাকো আর
তাই তব রহমত।
ক্ষমা কর হযরত।