Sylhet Today 24 PRINT

অপুর টিকটকের পাঁচালি

মাসকাওয়াথ আহসান |  ০৪ আগস্ট, ২০২০

টিকটক অপু নামের এক বিনোদন শিল্পীকে গ্রেপ্তার করা হয়; একটি মারধোরের অভিযোগ ও মামলা দেখিয়ে। অপুকে গ্রেপ্তারের ভিডিওতে পুলিশ তাকে যথারীতি ফকিন্নীর পুত বলে গালি দেয়; যেন পুলিশ ব্রিটিশ রাজপরিবার থেকে এসেছেন। পুলিশ ও উত্তেজিত গণপিটুনিপ্রবণ জনতা গ্রেপ্তারের সময় বলে, অর চুল কাইটা দে; কত্ত বড় সাহস হালার। গ্রেপ্তারের ভিডিওটি দেখলে মনে হয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর ভ্যাড়ভেড়ে গ্রাম যেন, মাথামুণ্ডন বা ইঞ্চিমত কাটে চুল কেটে দেয়া যেখানে সামাজিক পুলিশি সংস্কৃতির ধারা।

'অপু' গ্রেপ্তারের পর সংস্কৃতি পুরোহিতেরা তাদের হিতোপদেশ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেমেছে। ধর্মকে যেমন ধর্ম পুরোহিতেরা স্থবির একটি বিষয় বলে মনে করে; সংস্কৃতি পুরোহিতেরা ঠিক তেমনি সংস্কৃতিকে একটি অনড় পাথর বলে মনে করে। তাই "টিকটক" মানেই মূল্যবোধের অবক্ষয়; সংস্কৃতির ধস এরকম আহাজারি শোনা যায় মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি মামার কণ্ঠে।

অপুর টিকটক ভিডিও-তে কিছু কৌতুক করার চেষ্টা দেখা যায়; তার চুলে সে সোনালি রঙ করিয়েছে বিদেশি ফুটবলার ও গায়কদের মতো। ছেলেটির বয়স বোধ হয় বিশের দিকে; ফলে তার মধ্যে 'এক্স' ও 'জি এফ' শব্দ দুটি ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায়। যতটুকু পড়ালেখা জানে সে; ঐটুকু নিয়েই তার কনটেন্ট। যৌন অবদমনের সমাজের বাসিন্দা বলে, অপুর চিন্তায় লিবিডো বিরাজ করে কখনো-সখনো। সম্পন্ন বুড়োধাড়িরা যখন পাপিয়া নাচিয়ে উন্নয়নের শিখরে দুর্জয় ঘাঁটি গেড়েছে; সেখানে অপুর মধ্যে পিউ-পাপিয়ার হাহাকার আসবেই। কারণ উন্নয়নের পাপিয়া নাচানো আদু ভাইয়েরা এসমাজের সফলতার আইকন। গ্রামদেশে বলা হয়, "আগের গোরু যেদিক দিয়ে যায়; পিছের গোরু সেদিক দিয়েই যায়।"

বিজ্ঞাপন

গোটা পৃথিবীর ছেলে মেয়েরাই টিকটক ভিডিও করছে; এটাই ইন্টারনেট যুগের নতুন বিনোদন সংস্কৃতি। শিক্ষা ব্যবস্থায় অগ্রসর দেশগুলোর শিশুদের টিকটক ভিডিওতে; কনটেন্ট ভালো। আর দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থার দেশগুলোর টিকটকগুলোতে দুর্বল কনটেন্ট অপুর মতো। দুর্বল নাটক-চলচ্চিত্র-টকশো-গান-সাহিত্য যেভাবে গড়ে ওঠে; একইভাবে গড়ে ওঠে দুর্বল টিকটক।

শিশুকে বেড়ে ওঠার কালে ভালো গল্প পড়ে শোনাতে হয়; ভালো গান গেয়ে শোনাতে হয়; তার সৃজনশীলতার ঝোঁক বুঝে তাকে সংগীত, অভিনয়, ছবি আঁকা বা তার যেদিকেই ঝোঁক; তাতে সহযোগিতা করতে হয়। সে শিখে নেয় নিজেই; শুধু তাকে তার পছন্দের এলাকার অতীতের ভালো কাজগুলো দেখাতে হয়। এই কাজটি ভালো শিক্ষা-ব্যবস্থার দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা করেন। শিক্ষকেরা অভিভাবকদের স্কুলে ডেকে শিশুটিকে বাসায় কী কী বিষয়ে সহযোগিতা করতে হবে তা বুঝিয়ে দেন। সভ্যদেশের শিশুদের অভিভাবক ও শিক্ষক বা পুলিশ কেউ মারধর করেনা; "ফকিন্নীর পুত" বলে গালি দেয়না। ফেসবুকে হ্যান্ডকাফ পরা ছবি শেয়ার করে ফেসবুক ট্রায়াল করা হয়না। সমাজ-কল্যাণ বিভাগ কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে কিশোর অপরাধীকে ফিরিয়ে আনে অপরাধমুক্ত জীবনে।

কেবল বিংশ শতককে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর অনেকগুলো দেশ শিশুদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অপেক্ষাকৃত শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধের সমাজ গড়ে তুললো। কিন্তু এই বিংশ শতকেই দক্ষিণ এশিয়ার মায়াপ্রবণ সমাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর হয়ে পড়লো; পড়ালেকা দিয়া কী হয় "টেকা দ্যান দুবাই যামু" কিংবা "টেকা থাকলি পরে বাঘের চক্ষু মেলে"; এরকম দীন-হীন চিন্তা আর কমনসেন্স বর্জিত সমাজ কাঠামোতে।

প্রত্যেকটা যুগে কিছু পপকালচার ও ফ্যাশানের ঢেউ আসে। বিটলস-এর গানের যুগে; জন লেননের স্টাইল, বব মার্লির যুগে তার জীবন চর্যা, মাইকেল জ্যাকসানের যুগে তার অঙ্গসজ্জা, ব্রাজিলের ফুটবলার নেইমারের চুল রঙ করার যুগে তার হেয়ার স্টাইল বিশ্বময় জনপ্রিয় হয়।

টিকটক অপুর সোনালি রঙের চুলে শুধু চুল রঙ করা ব্রাজিলের ফুটবলার নয়; ম্যাডোনার হেয়ার স্টাইলের সঙ্গেও মিল পাওয়া যায়। ব্রাজিলের টেকো ফুটবলারদের অনুসরণে করোনাকালের শুরুতে মন্ত্রী থেকে কেরানি অনেকেই মাথার চুল ফেলে দিয়ে এলিয়েন সেজেছিলো; সে কথা মনে আছে নিশ্চয়ই।

টিকটক অপুর দুর্বলতা কনটেন্টে; কারণ স্কুল তাকে কিছু শেখায়নি। আর ফেসবুকে এতো সব বড় বড় ইন্টেলেকচুয়াল আলাপ; যেখান থেকে কিছু শেখার সুযোগ কম। সহজ জিনিসকে ঘুরিয়ে কঠিন করে বলে পাণ্ডিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার প্রয়োজনে যে আলাপ; অপুরা তা কী করে বুঝবে। আর অপু ইংরেজি না জানায়; তার জ্ঞানের জগত বাংলা ভাষার সস্তা নাটক, সস্তা রস, ইংরেজি না শিখলেও, ইয়েস নো ভেরি গুড এক্স জিফ ইত্যাদি শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অপুর শেখার মাধ্যম দুটোই; অষ্টাদশ শতকের সংস্কৃতি ভাবনার ফেসবুক পুরোহিত আর সপ্তম শতকের ধর্ম ভাবনার ফেসবুক মোল্লা। এই সীমাবদ্ধ জ্ঞানের জগত থেকে যে মানের টিকটক শিল্পী আসার কথা; অপু ঠিক তাই।

যেসব দেশে মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষা শিক্ষার ব্যাপারটাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ অনুপ্রাণিত করে; সেসব দেশের শিশুদের জ্ঞানের জগত বিস্তৃত। ফলে তাদের টিকটক ও ইউটিউব ভিডিও-র বিষয় বিস্তৃত।

বাংলাদেশে "ঘর হৈতে আঙ্গিনা বিদেশ" একভাষী জ্ঞানের জগতটি এতো সীমাবদ্ধ একটি জগত; যে সেই সীমাবদ্ধ জগতের খর্ব চিন্তার গজফিতা দিয়ে পৃথিবীর সব বিষয় মাপামাপিতে ফেসবুক এক জ্বলন্ত "মাতবর বাড়ির সালিশ" হয়ে ওঠে।

পাওয়ার প্ল্যান্টের বড় বড় লুটেরা-খুনি গ্যাং-গুলোকে নাগ-নাগিনীর খেলায় ছেড়ে রেখে; দু'দিন পর পর একটি তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির অপরাধী ধরে এনে পুলিশ ছেড়ে দেয় ফেসবুকে। ফেসবুকের নরভোজি সমাজ ঐ ক্ষুদ্র অপরাধীকে রোস্ট করে খায় আর বড় অপরাধীর পোস্টে গিয়ে 'সহমত' হয়ে কাঁচু মাঁচু হয়ে পড়ে। চাকরস্য চাকর মনোজগৎ মনিবের সঙ্গে সমস্বরে বলে, কেষ্টা ব্যাটাই চোর।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.