Sylhet Today 24 PRINT

টিলাগড়ের গ্রুপগুলা কি সিলেটের সর্বসাধারণের চাইতেও শক্তিশালী?

এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের প্রতিবাদ সোশ্যাল মিডিয়ায়

সোশ্যাল মিডিয়া ডেস্ক |  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে এক তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভ উত্তাল পুরো সিলেট। ক্ষোভ আছড়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও। এমসি কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী, সিলেটের সচেতন মহলসহ নানা ধরণের মানুষ এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনায় ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অপরাধীদের শাস্তির পাশপাশি কেনো এমসি কলেজ এলাকায় বরাবার এমন ঘটনা ঘটছে, কেনো এই এলাকায় বেপোরোয়া হয়ে ওঠেছে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন এমন প্রশ্নও তুলছেন তারা।

এ নিয়ে ফেসবুকে লেখক-মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হাসান মোরশেদ লিখেছেন-

শতবর্ষী কলেজ হোস্টেল জ্বালিয়ে দিয়েছিলো ছাত্রলীগের পদধারী চেনা দুর্বৃত্তরা। শিক্ষামন্ত্রী এই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন, সম্ভবত এই হোস্টেলেই থাকতেন। পুড়িয়ে দেওয়া ছাত্রাবাস পরিদর্শনে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পরেছিলেন সজ্জন বলে খ্যাত শিক্ষামন্ত্রী। দেশ বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা,নিন্দার ঝড়। তারপর  বিপুল টাকা ব্যয়ে পুরনো ডিজাইনে নতুন করে ছাত্রাবাস গড়ে উঠলো। সবাই খুশী।

কিন্তু যারা আগুন দিয়েছিলো তাদের কি বিচার হয়েছিলো?

২০১৩ তে বিএনপি-জামাত-হেফাজত মিলে শহীদ মিনার ভেঙ্গে দিলো। আবার নিন্দার ঝড়। শহরের অভিভাবক ও সজ্জন বলে খ্যাত অর্থমন্ত্রী পরিদর্শনে এলেন, ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। তারপর নতুন ডিজাইনে আরো দৃষ্টি নন্দন করে অনেক টাকা ব্যয়ে শহীদ মিনার হলো। চারদিকে প্রশংসা, সবাই খুশী।

কিন্তু শহীদ মিনার ভাঙার বিচার কি হয়েছিলো?

একটা সমাজ যখন ধামাচাপার উপর দিয়ে চলতে থাকে, প্রতিবাদ সব যখন প্রতীকি হয়ে উঠে, বিচারহীনতাই যখন সংস্কৃতি হয়ে উঠে এবং শেষ পর্যন্ত সবাই বেশ হাসিখুশী থাকে- তখন এমনই হয়, এমন হতেই থাকে।

 

চিত্রশিল্পী সত্যজিৎ চক্রবর্তী ফেসবুকে লিখেছেন-

প্রসঙ্গ এমসি কলেজে ধর্ষণ ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন :

টিলাগড়ের গ্রুপগুলা কি সিলেটের সর্বসাধারণের চাইতেও শক্তিশালী?কোন কোন গ্রুপ এখানে কার্যকর? কলেজ বন্ধ থাকলে হোস্টেল বন্ধ থাকলে কি তার সিকিউরিটিও বন্ধ থাকে? কলেজ অফিসিয়াল কি দায় এড়াতে পারে? কোন কিছু খারাপ ঘটলেই জনআন্দোলনের মাধ্যমে বিচার চাইতে হয় কেন? বিচার কি জনতার আন্দোলনের বিষয়?

বিজ্ঞাপন


বিচারতো একটা দেশে স্বয়ংক্রিয় হওয়াই উচিত। না হলে কিসের বিচার।তার মানে কি এই নয় বিচার প্রভাবিত করা হচ্ছে?

একটা সোসাইটিতে ভালো মন্দ একটা পার্সেন্টেজে ঘটতেই থাকে এখন কি সব অপঅরাধীকেই আন্দোলন করে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোই একমাত্র পন্থা নাকি এই বিচার প্রভাবক নেতা ও তার অনুসারিদের এবং সরকারের অফিসিয়ালদের বিরুদ্ধে জন-আন্দোলন দরকার? এবং পাওয়ার প্র‍্যাক্টিসের এই রাজনীতির দিকে আঙ্গুল তোলা দরকার কি না? রাজনৈতিক দলের কাজ কি কেবলি ক্ষমতার মসনদে আরোহন?

ক্রসফায়ার কি অপরাধ দুর্নীতি কমাতে পারে নাকি নিজেই আরো হাজার অপরাধের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়? একদল রেপিস্ট যদি আরেকদলের বিচার এবং একদল দুর্নীতি বাজ রেপের সমর্থক কি আরেকটি অনুরূপ ঘটনার সুষ্টু বিচার করতে পারে বলে আপনাদের ধারণা?

লেখক রানা মেহের এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে নিজের চেনা ক্যাম্পাস অচেনা হয়ে যাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন। ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন-

দেশ ছাড়ার আগের কথা। মান্না হঠাৎ ফোন করে বললো তার পরীক্ষার নিবন্ধনের আজই শেষ তারিখ। জেনেছে কিছুক্ষণ হলো আর এখন যেখানে আছে সেখান থেকে সিলেট আসা আজ কোন ভাবেই সম্ভব না। আমি যেন কাগজপত্র নিয়ে এমসি কলেজে গিয়ে তার নিবন্ধন করে আসি।

এমসি কলেজটা ঠিক দালান ভিত্তিক কলেজ না। টিলা জঙ্গল পুকুর বড় ঘাস মিলে ছড়ানো একটা জায়গা। তার মাঝে মাঝে বিভাগ গুলো। এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে যেতে বেশ একটু জল জঙ্গলের কাব্য পেরিয়ে যেত হয়।
শীতের সন্ধ্যা। আমি ছয়টার দিকে কাজ থেকে বেরুলাম। সব বিভাগে দৌড়াদৌড়ি করে, চেনা শিক্ষকদের বকা আর অচেনা শিক্ষকের জেরা পার করে কাজ শেষ হলো যখন, রাত আটটার মতো বাজে। সেইসময় সিলেটের জন্য, অন্ধকার এমসি কলেজের জন্য বেশ রাত। অস্বস্তি হয়েছে। ভয় লাগেনি। ভয় পায়নি মান্নাও। আরে এমসি কলেজ একটা ভয় পাবার জায়গা? স্কুলে ভর্তির আগে থেকে এই কলেজে হেঁটেছি।

এখনো এমসি আমার তেমনই মনে হয়। দেশে গেলে যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, একবার সেখানে যাই। এই কলেজের সবুজতো আমার নিজের। এই ছাত্রাবাস ছেলেদের হলেও আমাদেরও তো। মামা থাকতো সেখানে। কতবার গিয়ে বসে থেকেছি এমনি। পুরো ছাত্রাবাসের ছেলেরা মামা হয়ে গিয়েছিল তখন।

সেই কলেজে আমার এখনকার আ্যলুমনাইরা ধর্ষণ করেছে একটা মেয়েকে। বরকে বেঁধে রেখে মেয়েটাকে ছাত্রাবাসে নিয়ে গণধর্ষণ করেছে। মেয়েটা আর তার বর বেড়াতে গিয়েছিল কলেজে। আমার মতো শত শত মানুষ যেমন যায়। আমার না কেমন গা গুলাচ্ছে। কলেজটাকে মনে হচ্ছে অতীতের কিছু। কিংবা যা ছিলই না কখনো।

অভিযুক্ত ধর্ষকদের ছবি দেখলাম। ছাত্রলীগের যেই অংশটা বহুদিন ধরে সেই এলাকায় অপরাধের সাথে জড়িত, তারা তাদেরই সদস্য। আচ্ছা এরা কি আগেও করেছে এমন? হয়তো এই প্রথম নয়। আমরা হয়তো জানতেও পারিনি।

কী বিচার হবে আমি জানিনা। প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন এই দলটি তার কর্মীদের কী শেখায়, তুলবোনা সেই প্রশ্নটিও। শুধু জানি, এই সবুজে আর হাঁটা হবেনা নিশ্চিন্তে। কিংবা হাঁটলেও চোরাকাঁটার মতো পায়ে লেগে থাকবে সন্দেহ আর বিবমিষা।

এমসি কলেজর সাবেক শিক্ষার্থী, লেখক আরিফ জেবতিক নিজের সময়ের সাথে তুলনা করে এমসি কলেজের বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন-

এমসি কলেজে প্রথম গেছি ক্লাস সিক্সে থাকতে, বিজ্ঞান মেলায় স্কুলের দল হয়ে। এমসি কলেজ আসলে কলেজ না, প্রায় ৫শ বিঘার বিশাল আয়তনের ক্যাম্পাস। ভেতরে ছোট টিলা আছে, বড় প্রায় পাহাড় হতে পারত ধরনের টিলায় প্রিন্সিপালের বাংলো আছে, দীঘি আছে- অনেক কিছুই আছে।

বিজ্ঞাপন



ঢাকায় যেরকম মানুষ অবলীলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘিরে আড্ডা মারে, উৎসবে উচ্ছ্বাসে ছুটে যায়-এমসি কলেজও তেমনি।

এই কলেজে পড়েছি, ছাত্র রাজনীতির সাথে ঘনিষ্টভাবে মিলেছি। চব্বিশ বছর আগে যে বৈশাখী উৎসব শুরু করে দিয়ে এসেছি, শুনেছি বিরতিহীন ভাবে তা আজো চলছে, আজো পহেলা বৈশাখে এমসি কলেজ মুখরিত হয় নববর্ষের আবেশে।
আশি নব্বই দশকের অস্ত্রবাজি এই কলেজেও ছিল। তখন তো আজকের মতো পুলিশ রেব এর কড়াকড়ি ছিল না, চট করে মোবাইল বের করে কারো ছবি তোলারও সুযোগ ছিল না-তাই প্রতিটি সংগঠনের কাছেই অনেক অনেক অস্ত্র ছিল। প্রতি সংগঠনে ক্যাডার ছিল। মোল্লা ভাইয়ের ক্যান্টিনের ছোট রুমে, ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার ব্রিজের নিচে, বোটানি ডিপার্টমেন্টের পরিত্যক্ত হর্টি কালচার শেডের ভেতরে গুলি-ককটেল-চাপাতি-রামদা হকিস্টিক এর বড় বড় গুদাম থাকত।

কাটা রাইফেল কিংবা সিকান্দার বন্দুক ছিল এভেইলেবল, ছোটদের হাতে এলজি বা নিদেন পক্ষে টুটু পিস্তল।
পাশপাশি দুটো কলেজ। এমসি কলেজ আর সরকারি কলেজ। আমাদের সময় কোনো দেয়াল ছিল না। জাস্ট একটা ছোট নালা লাফ দিয়ে গেলেই এক কলেজ থেকে আরেক কলেজ। দুই কলেজেই সন্ত্রাস ছিল, মারামারি ছিল।
কিন্তু কিছু জিনিস কখনোই ঘটে নাই কোনো ক্যাম্পাসে। প্রিন্সিপাল হাসান ওয়াজেদ স্যার তাঁর ধূষর স্যুট আর লাল টাই পরে যখন প্রিন্সিপালের টিলা থেকে নামতেন, তখন অনেক বড় সংঘর্ষও নিমিষে থমকে যেত। একদম গুলাগুলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে স্যার রণহুংকার দিতেন। স্যাররা ছিলেন অফ লিমিট।

ছাত্রীদেরকে ডিস্টার্ব করা যায়, সেটা জানাই ছিল না সেকালে। নিজের কলেজের ছাত্রী মানেই ক্যাডারদের দায়িত্ববোধের মাঝে পড়ে-এই ছিল অনুভূতি।

প্রবল সংঘর্ষ হওয়ার পরে হয়তো একদল ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছে না, আরেকদল দিনরাত অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে-কিন্তু ছাত্রী নেত্রীদের কোনো অসুবিধা ছিল না।

ছাত্রদলের এপোলো আপা নিরাপদে ক্লাস করছেন, ছাত্রলীগ কিংবা শিবির হয়তো ঐ করিডোর দিয়েই জঙ্গী মিছিল নিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রলীগের নেত্রী কনা আপাকে হয়তো রিক্সা ডেকে দিচ্ছে ছাত্রদলেরই এক ক্যাডার, যে কলেজ গেটে বন্দুক হাতে পাহারা দিচ্ছে ছাত্রলীগ ঠেকাতেই। কিন্তু নারীদের জন্য নিরাপত্তাবোধের কোনো কমতি নেই।

বিকেলে বা সন্ধ্যায় আশপাশ থেকে অনেকেই নীরব ক্যাম্পাসে হাটতে আসতেন। আধো আলো আধো অন্ধকার, কেউ কখনো ভাবে নি যে ক্যাম্পাসে কারো নিরাপত্তাবোধের অভাব হবে। তাহলে আমরা আছি কী করতে !
তাই এমসি কলেজ আমাদের রক্তে মিশে আছে।

এই তো গত কয়দিন আগেই আমাদের বড় ভাইরা একটা প্রজেক্ট করলেন, বালুচর থেকে যে রাস্তাটা ডানে খেলার মাঠ আর বামে হোস্টেলকে চিরে কালো পিচে আকাবাকা চলে গেছে, তার দুপাশে শিমুল-জারুল-কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া লাগানো হবে। সেই গাছ লাগানো হচ্ছে, সেটা পাহারা দেয়ার লোক রাখা হয়েছে। হয়তো বছর দশেক পরে এই দুই কিলোমিটার রাস্তা দেখতেই লোকে ভিড় করবে।

সিলেট একদমই কম যাওয়া হয়, গত ৭ বছরে হয়তো ৩ বার গিয়েছি। তবু এমসি কলেজেও গিয়েছি। উন্নয়নের দেয়াল হয়েছে হোস্টেলে, মাঠে। দুই কলেজের মাঝেও দেয়াল উঠেছে। বিশাল গেট হয়েছে।
আমাদের সময় কোনো দেয়ালই ছিল না তেমন। আমরা প্রকৃতির সন্তান, অবারিত কলেজে সবাই ঢুকেছে বেরিয়েছে।
আজ দেয়ালও আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি।

সোয়াশ বছরের পুরোনো ক্যাম্পাসে একজন নারী ধর্ষিত হয়েছেন!

আমার ক্যাম্পাসকে এরা অপবিত্র করে তুলেছে।
আমার সিলেটকে এরা অপবিত্র করে ফেলছে।
এদেরকে ছাড়া যাবে না।

এদেরকে যারা বানাচ্ছে, যারা পালছে, যারা পুষছে-সবাইকে চিহ্নিত করতে হবে।

এই সবগুলোকে লাথি দিয়ে সুরমা নদীতে ফেলে দিতে হবে।

এই বদমাশের গুষ্টিকে প্রতিরোধে দলমত নির্বিশেষে সকল সিলেটিকে এগিয়ে আসতে হবে।
আমাদের হাতে আর কোনো অপশন খোলা নেই।

প্রসঙ্গত, শুক্রবার বিকেলে এমসি কলেজে বেড়াতে গিয়েছিলেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার এক দম্পত্তি। ছাত্রলীগের ৫/৬ জন নেতাকর্মীকে তাদের ধরে ছাত্রাবাসে নিয়ে আসে। সেখানে দুজনকেই মারধর করে তারা। পরে স্বামীকে বেঁধে রেখে তার সামনেই স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের শিকার তরুণী বর্তমানে ওসমানী হাসপাতালের ওসিসি সেন্টারে ভর্তি আছেন।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.